খুলনায় মন্দিরে উড়োচিঠিতে দুর্গাপূজা নিয়ে উদ্বেগ, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার
বাংলাদেশ

খুলনায় মন্দিরে উড়োচিঠিতে দুর্গাপূজা নিয়ে উদ্বেগ, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার

খুলনার দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন মন্দিরে দুর্গাপূজা পালন করতে পাঁচ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবির উড়োচিঠি পাওয়ার পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে। কোনও কোনও মন্দির পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানালেন পূজা উদযাপন কমিটির নেতারা। পুলিশ ও জেলা প্রশাসন মন্দিরে মন্দিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও উদ্বেগ কাটছে না বলে জানিয়েছেন তারা। 

আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে গত বুধবার বিভিন্ন মন্দিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কাছে এই চিঠি আসা শুরু হয়। গত শুক্রবার এ ঘটনায় উপজেলার চারটি মন্দিরের পক্ষ থেকে দাকোপ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। উড়োচিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দুর্গাপূজা পালন করতে হলে প্রতিটি মন্দিরের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে। একই সঙ্গে এ কথা প্রশাসন বা সাংবাদিকদের জানালে ‘কচুকাটা’ করা হবে।

পূজা উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিঠিতে বলা হয়েছিল দুর্গাপূজা করতে হলে প্রতিটি মন্দিরের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। এরপর থানায় জিডি করা হয়েছে। এ নিয়ে সভা করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সভায় অধিকাংশ লোকজন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা না পেলে পূজা না করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। আবার অনেকে বলেছেন, যদি প্রশাসন থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া হয় তাহলে পূজা করতে আগ্রহী। তবে এবার উচ্ছ্বাসের বদলে উদ্বেগ থেকে যাবে।

মন্দির কমিটির নেতারা বলেছেন, প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া হলে আমরা স্বল্প পরিসরে হলেও দুর্গাপূজা পালন করবো। এবার বড় পরিসরে কোনও আয়োজন থাকবে না। আর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা না পেলে আমরা দুর্গাপূজা উদযাপন থেকে বিরত থাকবো। চিঠি পাওয়ার পর আমরা ওই দিন রাতে এলাকার মানুষকে নিয়ে সভা করেছি। সেখানে বেশিরভাগ মানুষ পূজা না করার পক্ষে মত দেন। তবু সবাই মিলে পূজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। পাশাপাশি এখন থেকে এলাকায় প্রতিদিন পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে কিছু মন্দির কমিটি পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসন্ন দুর্গোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রতিটি মন্দিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সবগুলো মন্দির সুরক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর টিমসহ থানা পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। গ্রাম পুলিশ ও ইউনিয়নভিত্তিক পুলিশ কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক টহলে আছেন। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

কয়েকটি মন্দির ঘুরে দেখা গেছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে উপজেলাজুড়ে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। দেবী দুর্গার সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রতিমা নির্মাণে মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মন্দিরের সামনে কেউ কেউ পাহারা দিচ্ছেন। তবু অপরিচিত কাউকে দেখলেই কিছুটা ভীতি কাজ করছে তাদের মাঝে। 

পাঁচটি মন্দিরে পাঠানো চিঠিতে দেখা গেছে, সব কটি চিঠির বক্তব্য এক। হলুদ খামের ওপর প্রাপক মন্দির কমিটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। মন্দিরের সভাপতি-সম্পাদককে উদ্দেশে এসব চিঠি লেখা হয়েছে। চিঠির এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হানিফের প্রজেক্টে যেমন করেছি, তোদের পরিণতিও তেমন হবে।’

হানিফের প্রজেক্ট বিষয়টা কী জানতে চাইলে শ্রীনগর গ্রামের কয়েকজন জানান, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের চিংড়িঘেরে ব্যাপক লুটপাট চলে। কয়েকদিন ধরে চলে সে লুটপাট। এখনও সেখানে থাকা ছোটখাটো জিনিসপত্র লুটপাট চলছে।

শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি কেমন চলছে জানতে চাইলে দাকোপ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অসিত বরণ সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সব প্রস্তুতি ঠিক আছে। কোনও সমস্যা হয়নি। তবে কয়েকদিন আগে পাওয়া উড়োচিঠি নিয়ে সবার মাঝে উদ্বেগ কাজ করছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা সভা করেছি। উড়োচিঠিপ্রাপ্ত মন্দির কমিটির নেতারা থানায় জিডি করেছেন। পুলিশ টহলে আছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের হুমকি আমাদের সবার জন্য উদ্বেগের এবং আতঙ্কের। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শেষ পর্যন্ত প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে পূজা পালন থেকে সরে দাঁড়াবো। আর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমরা অবশ্যই পূজা করবো। প্রশাসন আমাদের পাশে থাকলে ভয় কেটে যাবে সবার।’ 

এ বছর উপজেলার ৮৩ সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে অসিত বরণ সাহা বলেন, ‘আমরা চাই, প্রত্যেকটি মন্দিরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।’

দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর বীণাপানি সার্বজনীন মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক বুদ্ধবেদ, রামনগর ঠাকুর বাড়ি সাবজনীন দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি অর্ধেন্দু শেখর, কামারখোলা ইউনিয়নের কালিনগর বাজার সার্বজনীন দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি তপন কুমার মন্ডল এবং সুতারখালী ইউনিয়নের পূর্বপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি কুমারেশ ডাকযোগে উড়োচিঠি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তারা জানান, চিঠি পাওয়ার পর থেকে আমাদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ কাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মন্দির কমিটির সভাপতি বলেন, গত বুধবার চিঠি পাওয়ার পর আমরা রাতে এলাকার মানুষকে নিয়ে সভা করেছি। সেখানে বেশিরভাগ মানুষ পূজা না করার পক্ষে মত দেন। তবু সবাই মিলে পূজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। পাশাপাশি এখন থেকে এলাকায় প্রতিদিন পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে কিছু মন্দির কমিটি পূজা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে সবার মাঝে উদ্বেগ ও ভীতি ছড়িয়ে গেছে। এটি শেষ পর্যন্ত কাটবে কিনা আমরা জানি না।

দাকোপের কামারখোলা সর্বজনীন দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শেখর চন্দ্র গোলদার বলেন, ‘এ বছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে পূজা না করে খুব ছোট পরিসরে করার আলোচনা করেছি আমরা। তবে এ ধরনের চিঠি পাওয়ার পর আমাদের সদস্যরা আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবু আমরা নিরাপত্তা পেলে পূজা করবো।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দাকোপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপজেলার পাঁচ মন্দিরে উড়োচিঠি এসেছে। এ নিয়ে থানায় জিডি হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। উপজেলার প্রতিটি মন্দিরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। গ্রাম পুলিশ ও ইউনিয়নভিত্তিক দায়িত্বশীলরা সার্বক্ষণিক টহলে আছেন। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসব চিঠি দিয়ে কেউ হয়তো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আসলেই কিছুই হবে না।’

এ বিষয়ে দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসমত হোসেন বলেন, ‘যেসব মন্দিরে উড়োচিঠি এসেছে সেগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সভা করেছি আমরা। পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি। পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্ত নিশ্চিত করা হবে। রাতে ও দিনে মন্দির সুরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি মন্দির এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে শক্তিশালী নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। ভয়ডরহীনভাবে সবাই পূজা উদযাপন করতে পারবে।’ 

Source link

Related posts

খুলনা করোনায় একদিনে সর্বোচ্চ ২৮ জনের মৃত্যু

News Desk

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ : নৌযান চলাচল বন্ধ

News Desk

টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত, কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি

News Desk

Leave a Comment