খুললো পদ্মা সেতু, কতটা প্রস্তুত দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়ক?  
বাংলাদেশ

খুললো পদ্মা সেতু, কতটা প্রস্তুত দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়ক?  

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোযগাযোগে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দক্ষিণের ২১ জেলার জনজীবনে। কৃষির উন্নয়ন, পর্যটন ও শিল্পের বিকাশে ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় এখন দক্ষিণের মানুষেরা। তবে সেতুর সুফল পেতে সংযোগ রক্ষাকারী সড়কেরও উন্নয়ন দরকার। নয়তো সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন পদ্মা সেতুর ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন জেলার মানুষেরা। বিশেষ করে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর বিভিন্ন জেলার সংযোগ রক্ষাকারী সড়কগুলো এখনও মানসম্মত হয়ে ওঠেনি। পদ্মা সেতুর কারণে এসব সড়কে যে চাপ বাড়বে তাতে দুর্ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।     

সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে পৌঁছেছে। তবে সেখান থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল, আর ৩০ কিলোমিটার উত্তরে ফরিদপুর শহর এবং ১৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে পায়রা ও ২০৩ কিলোমিটার দক্ষিণে কুয়াকাটায় পৌঁছার সড়ক-মহাসড়কের কোনোটিই মানসম্মত নয়। এসব মহাসড়ক এখনও মাত্র ১৮ থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত। পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করতে দ্রুত সম্ভব এসব সড়ককে চার লেনে উন্নিত করা প্রয়োজন।  

চার লেন না হলে মিলবে না পদ্মা সেতুর সুফল
গত ২৯ মে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ও বামরাইল এলাকার মাঝ বরাবর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাত্রীবাহী বাস দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত হন। ওই সময় স্থানীয়রা পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার আগেই বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক চার লেনে উন্নিত করার দাবি জানান।  

উজিরপুরের বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান মাসুম বলেন, পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দরকে সামনে রেখে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। এর মধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু। মহাসড়কে এখন যানবাহনের চাপ আরও কয়েকগুণ বেড়েছে।  

তিনি আরও জানান, সেতু খুলে দেওয়ার আগেই যানবাহনের চাপে ভূরঘাটা থেকে গড়িয়ার পাড় পর্যন্ত প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় মানুষ মরেছে। সেতু খুলে দেওয়ার পর এ দুর্ঘটনা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। 

গৌরনদী উপজেলার স্থানীয় সংবাদকর্মী গিয়াস উদ্দিন মিয়া বলেন, বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের অপ্রশস্ত সড়কের কারণে পদ্মা সেতুর সুফল শতভাগ পাবেন না স্থানীয়রা। কারণ সেতু পার হওয়ার পর বিভিন্ন সংযোগ রক্ষাকারী সড়কগুলো অপ্রশস্ত। এসব সড়কে বাড়তি যানের চাপ চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে। পাশাপাশি দুর্ঘটনাও বাড়বে কয়েকগুণ। 

বরিশাল সবুজ আন্দোলনের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর বরিশাল নগরীর মধ্যে থাকা বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের পাঁচটি হটস্পটে দ্রুত ওভারব্রিজ করে দিতে হবে। একইসঙ্গে অপ্রশস্ত মহাসড়কও প্রশস্ত করতে হবে।  

তিনি আরও বলেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মধ্যে বরিশাল নগরীর ১১ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এ কারণে মহাসড়কটি ব্যস্ত হয়ে পড়লে প্রতিদিনই প্রায় দুর্ঘটনা ঘটবে। এ জন্য বাইপাস সড়ক জরুরি হয়ে পড়েছে। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল জেলার সদস্য সচিব রফিকুল আলম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে চাপ বাড়বে, দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়বে বহুগুণ। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে ভাঙ্গা পর্যন্ত ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে পৌঁছালেও অন্য সংযোগ সড়কগুলো বেশ পুরনো। সেগুলো সংস্কার ও প্রশস্ত না হলে কোনও সুফল মিলবে না। 

বরিশাল বাইপাস বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক মকিবুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে ১১ কিলোমিটার বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের অংশে বাইপাস নির্মাণের আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনও কাজ দেখা যায়নি আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। এর মধ্যে দৃশ্যমান কোনও কাজ না হলে আন্দোলন শুরুর হুঁশিয়ারি দেন এই দুই নেতা। 

এদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পদ্মা সেতু এবং এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশ গুপ্ত বলেন, বরিশাল অঞ্চলের রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, অর্থনেতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের উদ্যোক্তাদের সামনে এখন জরুরি কাজ হলো সড়ক উন্নয়ন। 

তিনি ভাঙ্গা থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনা-পিরোজপুর-ভোলা-ঝালকাঠি সড়ক দ্রুত চার লেনে উন্নিত করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ঢাকা-ভাঙ্গা চার লেনের সড়ক থেকে যখন দুই লেনের সড়কে গাড়ি প্রবেশ করবে তখন গতি কমবে স্বাভাবিকভাবে। তখন কিন্তু এর দোষ চাপবে পদ্মা সেতুর ওপর। 

কেন থেমে আছে মহাসড়কের উন্নয়ন 
সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, ফরিদপুর থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১১ কিলোমিটার মহাসড়কের দু’পাশে আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে ১৮শ’কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয় একনেকে। তবে চার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কোনও অগ্রগতি নেই।

এমনকি সর্বশেষ চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা থাকলেও আগামী বছরের জুনের আগে তা সম্পন্ন হওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ প্রকল্পটির জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সর্বশেষ তারা এ লক্ষ্যে পুনরায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষাসহ অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে সংশোধিত নকশা প্রণয়নে তাগিদ দিয়েছে। 

প্রকল্পটির জন্য ২০১৫ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। তবে বরিশাল মহানগরীকে এড়িয়ে বাইপাস নির্মাণের বিষয়টি তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে নগরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাইপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে অ্যালাইনমেন্ট করতে প্রস্তাবিত রেলপথের সঙ্গে কিছুস্থানে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। এতে নকশা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।  

এ অবস্থায় বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক বাদ দিয়ে নতুন ছয় লেনের মহাসড়ক নির্মাণেরও চিন্তা করেছিল সড়ক অধিদফতর। কিন্তু মন্ত্রণালয় বিষয়টিতে সায় দেয়নি। এতে বিদ্যমান মহাসড়কটিকে ছয় লেনে উন্নয়নের সিদ্ধান্তই রয়ে যায়। তবে কবে এ মহাসড়কের বাস্তব কাজ শুরু হবে, তা বলতে পারছেন না কেউ। 

সরে যাবে মহাসড়কের পাশে নির্মাণাধীন পার্ক এদিকে আগের প্রকল্প পরিচালক অবসরে যাওয়ার পরে নতুন পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করে পূর্বের সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ডিপিপি তৈরির বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। 
 
দায়িত্বশীলরা যা বলছেন
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বরিশাল নগরীর অন্তর্ভুক্ত মহাসড়ক প্রশস্তকরণ এবং যান চলাচল উপযোগীকরণ বিষয়ক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয় দগত ২০ জুন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এ সভায় পদ্মা সেতু চালু হলে বরিশালের মহাসড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কে যানবাহনের চাপ, সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন। 

বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের বরিশাল নগরীর অভ্যন্তরের ১১ কিলোমিটার সড়কের বিষয়ে বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তাপস কুমার পাল বলেন, নগরীর সীমান্ত গড়িয়ারপাড় থেকে দপদপিয়া ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করা হবে। এক্ষেত্রে নথুল্লাবাদ থেকে সিঅ্যান্ডবি কলোনি পর্যন্ত যে ডিভাইডার রয়েছে তা ভেঙে মহাসড়কের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে। ডিভাইডারের দুই পাশে যে সড়ক রয়েছে তাও মহসড়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া সড়কের পাশে সড়ক ও জনপথের জমিও মহাসড়কে মধ্যে চলে যাবে। এতে করে মহাসড়কের প্রশস্ততা বাড়বে। একইসঙ্গে আমতলার মোড় আরও প্রশস্ত করা হবে।

সভায় ট্রাফিক পরিদর্শক আবদুর রহিম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সুরভী পেট্রল পাম্প থেকে দপদপিয়া সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ, রাস্তার দুই পাশে থাকা দোকাটপাটসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ বেশ কিছু সমস্যা মেয়রকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি সব কিছু শুনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনা রোধে নগরীর মধ্যে মহাসড়কের একাধিক হটস্পটে ফ্লাইওভার নির্মাণ হবে। এতে করে পথচারীদের কোনও সমস্যা থাকবে না। এছাড়া নগরবাসীর সুবিধার্থে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের একটি অংশে নির্মিতব্য পার্ক সরিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

 

Source link

Related posts

স্বামী-শশুর আটক মিরসরাইয়ে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু

News Desk

পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতেই ভাঙনে দৌলতদিয়ায় ফেরি ঘাট

News Desk

সচিবকে নামিয়ে ফেরার পথে আগুনে পুড়লো জেলা প্রশাসনের স্পিডবোট

News Desk

Leave a Comment