যশোরের পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে বিশাল একটি ‘শিশুগাছে’ উঠে ডাল ভেঙে নিচে ফেলছেন টিপু সুলতান। নিচে থাকা তার সহযোগী হাফিজুর রহমান ডাল ভেঙে পাতা ও পরিষ্কার ডাল ফেলে দিচ্ছেন। সংগ্রহ করছেন, যে ডাল তুলোর মতো সাদা আবরণে ঢাকা সেটি। তাদের দেখে যে কেউ থমকে দাঁড়ান। জানতে চান, কী সংগ্রহ করছেন। কৌতূহলবশত এই প্রতিনিধিও জানতে চান কি করছেন? জবাবে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভাইরাস সংগ্রহ করছি।’ ভাইরাস? তা কেমন, উত্তরে বলেন, ‘আমরা গাছের ডালে লেগে থাকা এই সাদা অংশকে ভাইরাস বলি। এগুলো সংগ্রহ করে বেচে সংসার চালাই।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাফিজুর রহমানের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামে। তিনি যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। এই ভাইরাস সংগ্রহ ছাড়াও দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। মূলত গাছ থেকে সংগ্রহ করা ভাইরাস দিয়েই চলে এই দুজনের সংসার।
কেন এর নাম ভাইরাস?
এটি গাছে সংক্রমিত লাক্ষা নামে এক পরজীবী পোকার নির্যাস বা রস। যা স্থানীয়ভাবে ভাইরাস নামকরণ করা হয়েছে। যশোরের মণিরামপুর ও কেশবপুর এলাকায় গত বছর থেকে গাছের ডাল ভেঙে স্থানীয় লোকজন এগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করে আসছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যশোর সরকারি এমএম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জিল্লুল বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘Laccifer Lacca-হলো প্রাকৃতিক ও বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত লাক্ষা পোকা। ভারত ও বাংলাদেশে মূলত এর চাষ হয়ে থাকে। বিভিন্ন পোষক উদ্ভিদের ওপর (যেমন; বরই, পলাশ, কুসুম প্রভৃতি) লাক্ষা পোকা পরজীবী হিসেবে আশ্রিত থেকে আশ্রয়দাতা উদ্ভিদের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। নারী লাক্ষা পোকার দেহ থেকে নিঃসৃত আঠালো পদার্থ (Resin) খাদ্য তৈরিতে, চিকিৎসাকাজে ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই রেজিনের বর্ণ সাধারণত লালচে কিংবা কালচে খয়েরি হয়ে থাকে।’
কোন কাজে লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটিকে এক ধরনের ভাইরাস বলে; যা প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করা, ত্বকের আলসার ও ত্বকের বিভিন্ন রোগ নিরাময় করা, ছত্রাক আক্রমণ নিরাময় করার জন্য ইউনানী পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে।’
কোথায় পাওয়া যায়?
হাফিজুর রহমান জানান, তারা যশোরের বিভিন্ন এলাকায় শিশুগাছ, রেইনট্রি, আকাশমণি, বরই ও বাবলা গাছে এসব ভাইরাস পেয়েছেন। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁ, সন্দেশখালির আশপাশের এলাকার একদল মানুষ শিরিষ গাছ থেকে ভাইরাস সংগ্রহ করা হয় বলে শোনা যায়।
প্রক্রিয়া পদ্ধতি
সংগৃহীত ডাল বাড়ি নিয়ে ছুরি দিয়ে সেখান থেকে থেঁতলে সাদা আবরণসহ এর নিচে থাকা টকটকে লাল বা খয়েরি রঙের পদার্থ আলাদা করা হয়। এই অংশটুকু ওজনে বিক্রি করেন সংগ্রহকারীরা।
হাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাঁচা অবস্থায় প্রতি কেজি ৪০০ টাকা এবং শুকানো হলে ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মৌতলা আড়তে এগুলো বিক্রি করি। প্রতিদিন ছয়-সাত কেজি বিক্রি উপযোগী ভাইরাস সংগ্রহ করা যায়।’
বর্ষার শেষের দিক থেকে শীত মৌসুম পর্যন্ত এই ভাইরাস সংগ্রহ হয় জানিয়ে হাফিজুর বলেন, ‘গত বছর এক মণের বেশি ভাইরাস বিক্রি করেছিলাম। তা দিয়ে চলে আমার জীবন-জীবিকা।’