গাজীপুরে দার্জিলিং কমলা চাষে চমক
বাংলাদেশ

গাজীপুরে দার্জিলিং কমলা চাষে চমক

নাম দার্জিলিং কমলা। গাছে গাছে ঝুলে আছে এই হলুদ কমলা। খেতেও বেশ সুস্বাদু। এই কমলা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর পশ্চিমপাড়া গ্রামের মো. সবুজ মিয়া। কমলা বিক্রি করে এখন আয়-রোজগার ভালো হচ্ছে তার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো বাগানের যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে শুধুই কমলা আর কমলা। কোথাও ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে সবুজ রঙের কমলা মিশে সবুজে-সবুজে একাকার হয়ে আছে। কোথাও আবার সবুজ রঙের পাতার ভেতর থরে থরে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে হলুদ রঙের পাকা কমলা। প্রায় তিন একর জায়গাজুড়ে বাগানটিতে রয়েছে দার্জিলিং ও চায়না জাতের কমলা। এর মধ্যে দার্জিলিং জাতের ১০০ কমলা গাছ থেকে বেশি ফলন পেয়ে খুশি চাষি সবুজ মিয়া। বাগান থেকেই সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন। নিজ হাতে ছিঁড়ে কমলার স্বাদ নিচ্ছেন কোনও কোনও দর্শনার্থী। 

চায়না জাতের হলুদ ও সবুজ রঙের মেন্ডারিং কমলা থোকায় থোকায় ঝুলে গাছের ডালপালা নুইয়ে গেছে। ৩০ টাকা প্রবেশ মূল্যে সারিবদ্ধভাবে দর্শনার্থীরা বাগানে প্রবেশ করে গাছ থেকে কমলা ছিঁড়ে খাচ্ছেন।

চাষি সবুজ মিয়া জানান, চাষের দুই বছরের মাথায় ফলন আসা শুরু হয়। অন্যান্য ফসলের চেয়ে তুলনামূলক কম পরিশ্রমেই এটি লাভজনক চাষ। ফলনের তৃতীয় বছরে চাষের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আরও প্রায় ৩৫ শতক জমিতে চারা রোপণ করেছেন। বাগান থেকেই প্রতি কেজি দার্জিলিং কমলা বিক্রি করছেন ৩০০ টাকা কেজি দরে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে চায়না মেন্ডারিং জাতের কমলা বিক্রির আশা করছেন তিনি।

ক্রেতারা নিজ হাতে কমলা ছিঁড়ে ওজনে পরিমাপ করে নিয়ে যাচ্ছেন। সারাদিন তার কমলা বাগানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। আবার দর্শনার্থীরাই হলেন কমলার ক্রেতা। প্রতিটি গাছে গড়ে ৩০ কেজি ফল পেয়েছেন। মৌসুমের এখনও বেশ কিছুদিন বাকি। আরও ফলনের আশা করছেন সবুজ।

কমলা বাগানের কথা মানুষের কাছ থেকে শুনে ঘুরতে এসেছি বলে জানালেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এত সুন্দর বাগান এবং ফলন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিদেশি ফল আমদানির জন্য আমাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়। এখন দেশে উৎপাদিত এই ফল বিদেশে রফতানি করা যাবে। বাড়ির আঙিনা ও ছাদে চাষ করলে ভবষ্যিতে কমলা আমদানি করা লাগবে না।’

একই বাগানে ঘুরতে আসা সুমন বলেন, ‘ফেসবুকে কমলার বাগানের ছবি দেখে ঘুরতে এসেছি। দেখে খুব ভালো লেগেছে। এত সুন্দর বাগান। এটি আমাদের দেশের ও কৃষকদের জন্য অনুপ্রেরণা হবে।’

বাগান শুরুর কথা জানিয়ে চাষি সবুজ মিয়া বলেন, ‘শুরুতে চার বন্ধু মিলে বাগান করার পরিকল্পনা করি। এখানে আকাশমণির বাগান ছিল। উদ্যোগ নেওয়ার পর নাটোরের কৃষিবিদি গোলাম মাওলাসহ অভিজ্ঞ কয়েকজনের কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে বাগান শুরু করি। আশা করছি ভবিষ্যতে এর চেয়ে তিন গুণ বেশি ফলন হবে। গত বছর কিছু ফলন হয়েছিল। আকার, আকৃতি ও স্বাদ যাচাইয়ের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এবার সবই উন্মুক্ত আছে। প্রায় এক একর জায়গার মধ্যে চারা রোপণ করা হয়েছে। শতাধিক দার্জিলিং এবং অর্ধশতাধিক চায়না মেন্ডারিং জাতের কমলার চারা রয়েছে। প্রতিটি গাছে কমপক্ষে ৩০ কেজি পরিমাণ কমলা এসেছে। ৩০০ টাকা কেজি দরে দার্জিলিং কমলা বিক্রি করছি।’

উদ্যোক্তাদের একজন নেত্রকোনার ওয়ালী উল্লাহ বায়েজীদ বলেন, ‘দুটি জাতের কমলা উৎপাদন করছি আমরা। দার্জিলিং এবং মেন্ডারিং। ইন্ডিয়া এবং সিলেটের লাল মাটিতে এই কমলা উৎপাদন হয়। ২০০০ সালে ঝিনাইদহে কমলার উৎপাদন দেখেছি। তা দেখেই চাষে উদ্যোগী হই। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে দেখি গাজীপুরে লাল মাটিতে কমলা উৎপাদন সম্ভব। এখানে লাগানোর পর প্রথম উৎপাদনের বছরেই কখনও দুইটা আবার কখনও তিনটা কমলা এক কেজি পরিমাণ ওজন হয়েছে। চলতি বছর দার্জিলিং ও চায়না মেন্ডারিং দুটোই ভালো উৎপাদন হয়েছে। গাজীপুরের ফাঁকা লাল মাটির জমি ফেলে না রেখে কৃষি অফিসের সহায়তা নিলে ওসব জায়গায় কমলা উৎপাদন করা সম্ভব। পরিচর্যা ঠিকমতো করলে দেশের বাইরে থেকে আনা কমলার যে গুণগত মান, তা থেকে আমাদের দেশের কমলার গুণগত মান সেরা হবে।’

কমলার ফুল আসা থেকে শুরু করে হার্ভেস্ট করা পর্যন্ত কোনও মেডিসিন প্রয়োগ করতে হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে ফুল আসার আগে গাছের সুস্থতার জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। দেশের মাটিতে যে কমলা হয়, সুমিষ্ট হয়। স্বাদ হয়, রস ঠিক থাকে। একসময় দেশের বাইরে থেকে কমলা আমদানি করতে হবে না। এজন্য সবাইকে চাষে উৎসাহী হওয়ার আহ্বান জানাই।’

দর্শনার্থী মানিক মিয়া বলেন, ‘আমি পাশের এলাকা থেকে বাগান দেখতে এসেছি সপরিবারে। হাতের কাছে কমলা গাছ থেকে ছিঁড়ে খাচ্ছি। বেশ মজা পাচ্ছি। অনুভূতি অসাধারণ।’

দর্শনার্থী আনিসুর রহমান শামীম বলেন, ‘গাজীপুরের মাটিতে বিশেষ করে লাল মাটিতে কমলা হয়, এটা অবাক করার মতো। যারা কমলা চাষে আগ্রহী নিশ্চিন্তে তারা গাজীপুরের মাটিতে চাষ করতে পারেন।’

গাছে গাছে ঝুলে আছে এই হলুদ কমলা

কমলা উৎপাদনের ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজের শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক আকন্দ বলেন, বিশ্বে কমলা চাষের ইতিহাস প্রায় ৪ হাজার বছর আগের। বিজ্ঞানীদের ধারণামতে, সর্বপ্রথম কমলার চাষ হয় চীনে। পরবর্তীতে এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় এটির প্রচলন দেখা যায়। ধীরে ধীরে তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাজারে যেসব কমলা পাওয়া যায়, বেশিরভাগ দেশের বাইরে থেকে আসে। সিলেট অঞ্চলে কমলা উৎপাদন হতো। কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদানের কারণে কমলা এখন প্রায় বিভিন্ন জেলায় উৎপাদন হচ্ছে। এখন দেশের ভেতরেই বিভিন্ন বাগানে দেখতে পাওয়া যায়। চাষ বাড়তে থাকলে একসময় আমাদের দেশের উৎপাদিত কমলা দিয়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।’

এ ব্যাপারে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমাইয়া সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্রীপুর কমলা চাষের জন্য উপযোগী। সাতখামাইর এলাকায় দার্জিলিং কমলার সাইজ এবং স্বাদ অসাধারণ। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছি না, এটা আমাদের দেশীয় কমলা। ১০ বছর আগেও ধারণা ছিল না, আমরা দেশের গাছ থেকে বিদেশি কমলা ছিঁড়ে খেতে পারবো। কৃষি কর্মকর্তারা বেশ ভূমিকা রেখেছেন। আমি আশা করছি, দেশে আরও উদ্যোক্তা তৈরি হবে। আমাদের দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে কমলার পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারবো।’

Source link

Related posts

হাসপাতালে শয্যা ৭২, শীতজনিত রোগ নিয়ে ভর্তি ৪০৫

News Desk

কঠোর বিধিনিষেধ ‘অনেকটাই ঢিলে’ হয়ে গেছে

News Desk

দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৬১ জনের মৃত্যু

News Desk

Leave a Comment