করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মারা গেছেন মাহাবুব রহমান খান ডলার। এর পর থেকে মা রুবিনা আক্তার ছিলেন রোহানের একমাত্র আদর, স্নেহ, ভালোবাসা পাওয়ার স্থল। বছর ঘুরে ২০২৩-এর ডিসেম্বরে মাকেও হারিয়ে ফেলল রোহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষকের প্রাইভেট কারের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় রুবিনার।
এক বছরের ব্যবধানে মা-বাবাকে হারিয়ে রোহান এখন নির্বাক। কাঁদতেও ভুলে গেছে সে। চুপচাপ বসে থাকছে কোথাও। হাজারো প্রশ্নের পরও কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আজাহার জাফর শাহর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় রুবিনার। আজ তার তেজগাঁও ৭৫/২ তেজকুনিপাড়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায় ডাইনিংটেবিলে নিশ্চুপ বসে আছে একমাত্র ছেলে রোহান। খালা, ফুফুরা তাকে ঘিরে বসে আছেন। সবাই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কারো সঙ্গেই কথা বলছে না সে।
রোহানের দূর সম্পর্কের নানা মির্জা রুহুল আমীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর ছেলেটা শোকে পাথর হয়ে গেছে। কোনো কান্নাকাটিও করতে পারছে না। কখনো স্থির হয়ে বসে আছে, কখনো পায়চারি করছে। ’
ফুফু আফরোজা সুলতানা ডলি বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তেমন কিছুই খায়নি রোহান। কারো সঙ্গে কথাও বলছে না। অনেক মানুষের উপস্থিতি দেখে বাসা থেকেই বের হয়ে যায় রোহান। ’
রুবিনার স্বজনরা জানান, রোহান তেজগাঁও ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মাহবুবুর রহমান ডলারের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে স্বামীর বাড়িতেই থাকতেন রুবিনা। বাড়িভাড়া দিয়ে চলত সংসার।
রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন জানান, তারা দুই ভাই ও পাঁচ বোন। তাদের বাড়ি হাজারীবাগে। স্বামীর মৃত্যুর পর রুবিনা বিভিন্ন প্রয়োজনে হাজারীবাগে ছুটে যেতেন। গতকালও (শুক্রবার) তিনি হাজারীবাগে যাওয়ার উদ্দেশেই বাসা থেকে বের হয়েছিলেন।
ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার বিকেল ৪টার দিকে রুবিনার লাশ তেজগাঁওয়ে নেওয়া হয়। সেখন থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়িতে নিয়ে বাদ মাগরিব জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গত শুক্রবার দেবর নুরুল আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন রুবিনা আক্তার। পথে ঢাবির চারুকলা অনুষদের বিপরীতে একটি প্রাইভেট কার পেছন থেকে তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এ সময় গাড়ির বাম্পারে আটকে যাওয়া রুবিনাকে নিয়ে বেপরোয়া গতিতে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতের দিকে যান চালক। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তোরণের কাছে গাড়িটি আটকে রুবিনাকে জীবিত উদ্ধার করেন পথচারীরা। একই সঙ্গে গাড়ির চালককে পিটুনি দেওয়ার পাশাপাশি গাড়িটিও ভাঙচুর করেন তারা। পরে সেখান থেকে রুবিনাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় বাদী হয়ে নিহতের ভাই জাকির হোসেন সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন।
শনিবার (৩ ডিসেম্বর) মামলাটির এজাহার আদালতে আসে। এরপর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহাম্মদ মামলার এজাহার গ্রহণ করে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মো. জাফরকে মামলার তদন্ত করে আগামী ৯ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়া বলেন, চালক আজহার জাফর হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। শাহবাগ থানা পুলিশ তাকে পাহারায় রেখেছে।
হাসপাতালে আজহার জাফরকে দেখভাল করছেন মোছা. মনি নামের এক নারী। শনিবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘স্যার গুলশান-১ নম্বরে থাকেন। তার পরিবারে কেউ নেই। উনি একাই থাকেন। আমি ওনার বাসায় আট বছর ধরে কাজ করি। এই আট বছরে বাসায় ওনার স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন কাউকে আসতে দেখি নাই। ’