বাংলাদেশে গুমের ব্যাপারে জাতিসংঘের তালিকায় ত্রুটির অভিযোগ সম্পর্কে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালের মন্তব্য নিয়ে সম্প্রতি হইচই পড়ে যায়। ‘বিচারের নামে প্রহসন : বাংলাদেশে গুম নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ত্রুটির সমালোচনা বিশেষজ্ঞদের’ শিরোনামে ২ অক্টোবর সুলতানা কামালের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ভারতের ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়া টুডে। শুক্রবার সাক্ষাৎকারটির পুরো স্ক্রিপ্টটি প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমটি।
সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন ১ : জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলোর পক্ষে কী কিছু বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করা ন্যায়সঙ্গত, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে অধিকারের মতো সংগঠন সমালোচনার মুখে পড়ে?
উত্তর : বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে বিষয়বস্তু যাচাই না করে, বিশেষ করে মামলার সংখ্যা ও মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সংস্থার দেওয়া তালিকার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা কোনো দায়িত্বশীল সংস্থার জন্য সুবিবেচনাপ্রসূত বা যথাযথ নয়। এটি ইস্যুটির গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। এটিও মনে রাখতে হবে-একটি তালিকায় সংখ্যা বা পরিসংখ্যানের ভুল সমস্যাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ করে দেয় না। কিংবা এর অর্থ এটাও নয়-অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে এইচআরডব্লিউ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভূমিকা ন্যায্য ছিল না। এছাড়া ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হচ্ছে না। গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতির ব্যাপারে তাদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক এবং এটি মানবাধিকার সংস্থার বিষয় হয়ে উঠছে না। এটা সত্য যে, মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করা সংস্থাগুলোকে তাদের তথ্যের উৎসগুলো বিবেচনার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত। তবে এর অর্থ এই নয়, জাতিসংঘের উত্থাপিত উদ্বেগকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হবে না। ভুক্তভোগীদের মনের যন্ত্রণা, দুঃখ, ভীতিকে যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সমাধান করা উচিত।
প্রশ্ন ২ : বাংলাদেশের একটি রক্তাক্ত অতীত আছে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়কালে ১৯টি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। জেনারেল এরশাদের আমলেও একই প্রবণতা ছিল। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে খালেদা জিয়ার অধীনে পুরোপুরিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট কর্তৃক সহিংসতা শুরু হয়। শুধু আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং কিন্তু বিরোধী জোটের ওপর একই ধরনের চাপ দেওয়া হয়নি। আপনি কি এটিকে একটি ন্যায্য পদ্ধতি হিসাবে দেখেন?
উত্তর : আমি মনে করি না, অতীতে অন্য অপরাধীদের ওপর তাদের অপরাধের জন্য কোনো চাপ তৈরি করা হয়নি। এটিকে বর্তমান সময়ে সংঘটিত অপরাধগুলো উপেক্ষা করার বা স্বীকার করার জন্য অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। এ ধরনের নৃশংসতা বন্ধের জন্য সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর বারবার প্রতিবাদ ও দাবি জানানো সত্ত্বেও মানবাধিকারের নিয়ম লঙ্ঘন করে-এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অতীতে অন্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি বলেই বর্তমান অপরাধীদের বিষয়টি বাদ দেওয়া যায় না।
প্রশ্ন ৩ : বিএনপির পক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভুয়া অভিযোগের রেকর্ড রয়েছে, যা ইতোপূর্বে ডেইলি স্টার এবং দেশের অন্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
উত্তর : মানবাধিকার লঙ্ঘনের জালিয়াতি ইতোমধ্যেই বিএনপির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এজন্য যথাযথ ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ৪ : আপনি কি মনে করেন, উভয় দলের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বা বিএনপির অধীনে অধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশ নিরাপদ?
উত্তর : একটি সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়পরায়ণ সমাজের জন্য আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার প্রশংসনীয়। তবে এসব অঙ্গীকারের কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়নি। একজন মানবাধিকারকর্মী হিসাবে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা কেবল প্রমাণের ভিত্তিতে কথা বলতে পারি। সরকার ও রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে বলপূর্বক গুম বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ভিন্নমতকে দমনের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান ও পুনরাবৃত্ত প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। নাগরিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য এ ধরনের হুমকির মুখে তাদের সুরক্ষার সুস্পষ্ট দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে। এসব ঘটনার যথাযথ ও কার্যকর তদন্তের জন্য সুশীল সমাজের সংগঠন, অ্যাক্টিভিস্ট, সংবাদমাধ্যম এবং খোদ সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।