স্ত্রীর গলাব্যথার ওষুধ আনতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী লাশ হয়ে ফিরবেন তা স্বপ্নেও ভাবেননি স্ত্রী মরিয়ম বেগম। তাইতো এক প্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। স্বামী হারিয়ে মাতম থামছে না তার।
জানা গেছে, স্ত্রীর গলায় ব্যথা। তাই রবিবার মাগরিবের নামাজ আদায় করে স্থানীয় বাজারে ওষুধ আনতে যান প্রায় ৬৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী। সেখানে একটি ওষুধের দোকানের সামনেই বসে ছিলেন। ঠিক এই সময়ে পুলিশের সঙ্গে দিনাজপুর বিরলের আজিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ বাধে। একটু বয়স্ক হওয়ায় তিনি দৌড়ে পালাতে না পেরে ওষুধের দোকানের সামনে একটি বেঞ্চে বসে ছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি ছোড়ে। একটি গুলি এসে লাগে তার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গেই লুটিতে পড়েন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই কেউই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। পরে পুলিশ সদস্যরাই তাকে একটি অটোরিকশায় তুলে দিয়ে হাসপাতালে পাঠান। রাত ৯টায় হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই সংঘর্ষের ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য ও গুলিবিদ্ধ তিন জন ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে।
সোমবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে আজিমপুর ইউনিয়নের সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির বারান্দায় বসে কান্না করছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ।
সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে নিহতের মরদেহ হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় নিজ বাড়িতে। এ সময় কান্নার রোলে চারপাশ আরও ভারী হয়ে ওঠে। সেখানে ছুটে যান জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ ও পুলিশ সুপার শাহ্ ইফতেখার আহমেদ। নিহতের পরিবারের আর্থিক সহযোগিতা ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। বিকালে তার নামাজে জানাজা শেষে সিঙ্গুল কবরস্থানে দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়। নিহত মোহাম্মদ আলী সাঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপজেলার সিঙ্গুল হামিদ-হামিদা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সদস্য প্রার্থীর ফল ঘোষণা করলে ১৯ ভোটে ব্যবধানে জয় পান জোবায়দুর রহমান। অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজয় মানতে না পারায় সাইফুল ইসলামের আহ্বানে ভোট পুনরায় গণনা হয়। তাতেও জয় পান জোবায়দুর রহমান। এরই মধ্যে নির্বাচনি ফলের শিট নেওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় সমর্থকরা কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেন।
দিনাজপুর পুলিশ সুপার শাহ্ ইফতেখার আহমেদ বলেন, কেন্দ্রে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল মারে এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ বাধা প্রদান করলে বাধা উপেক্ষা করে পুলিশের ওপর হামলা করে। সরকারি জানমাল রক্ষা, আত্মরক্ষা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি ছুড়ে পুলিশ। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ওই ব্যক্তিসহ কয়েকজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এই সংঘর্ষের ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
ঘটনার পর এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সিঙ্গুল হামিদ-হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় সতর্ক অবস্থানে আছে পুলিশ। বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল।
নিহতের শ্যালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি হজ করে এসেছেন। এরপর থেকে শুধু নামাজ আদায় করার জন্য বাজারে যেতেন। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা মানসিক প্রতিবন্ধী, হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না। ইউপি নির্বাচনে তার এক ভাতিজা ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি দেখতে গিয়েছিলেন মাত্র। সংঘর্ষের সময় বয়স্ক মানুষ হওয়ায় তিনি দৌড়ে পালাতে পারেননি। এরপর তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সে সময় রাস্তাঘাট সবকিছুই বন্ধ ছিল, আধাঘণ্টা ওষুধের দোকানের সামনে পড়ে ছিলেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার সঙ্গে আমাদের শেষ কথাটাও হয়নি।
নিহতের ভাতিজা রোকনুজ্জামান সজল বলেন, আমার বড় আব্বু বাজারে গিয়েছিলেন বড় আম্মুর ওষুধ আনার জন্য। ওই সময়ে বাজারের পাশের ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে পুলিশ বাজারে গুলি চালালে আমার বড় আব্বু গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি মারা যান।
নিহতের নাতি তানভির হাসান বলেন, আমার দাদু বাজারে যাওয়ার পর সংঘর্ষ হয়। এ সময় দাদুর একটি গুলি লাগে। পরে তিনি সেখানে আধাঘণ্টা পড়ে ছিলেন। পুলিশের সদস্যরাই তাকে অটোতে করে হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে যাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
নিহতের প্রতিবেশী তমিজ উদ্দিন বলেন, মোহাম্মদ আলী চাচা একজন ভালো মানুষ। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এই ঘটনার আমরা সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক এটাই আমরা চাই।
স্থানীয় তুহিন ইসলাম বলেন, সংঘর্ষের পর গিয়ে দেখি, বাজারে রক্তাক্ত অবস্থায় মোহাম্মদ আলী চাচা পড়ে রয়েছেন। পরে পুলিশ সদস্যরাই আমাকে বলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেখানে আমি একটি গুলির খোসা পেয়েছি। চাচা খুবই নিরীহ মানুষ, কোনও রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
স্থানীয় নুরুল ইসলাম বলেন, আমার চাচা, একসঙ্গেই নামাজ আদায় করেছি। তারপর তিনি বাজারে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বলি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেন, চাচির গলাব্যথা। তাই ইলিয়াস ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন ওষুধ আনতে। পরে শুনি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। আপাতত নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছে তা কখনও কাম্য নয়। তদন্ত সাপেক্ষে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একইসঙ্গে ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত না তাদেরকে কোনোভাবেই হয়রানি করা হবে না- এটা আমি বলতে পারি। এরপরও যদি এই ধরনের কোনও ঘটনা আপনারা (সংবাদকর্মী) জেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে জানাবেন।