নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য। বাড়ছে জীবন ধারণের অন্যান্য খরচ। কিন্তু বাড়ছে না মানুষের আয়। করোনায় বিপর্যস্ত অনেকের আয় আবার কমে গেছে। চাকরিও হারাতে হয়েছে কাউকে কাউকে। চারদিকের নানা চাপে মানুষ যখন দিশাহারা তখন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে সেবা সংস্থাগুলো। এতে নতুন করে আতঙ্ক ভর করেছে জনজীবনে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে নতুন করে এসব সেবার বাড়তি মূল্য যোগ হলে মানুষ বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন- এর সরাসরি প্রভাব পড়বে জনজীবনে। সরকারি হিসাব বলছে, গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে গ্যাসের দাম। একই সময়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। গত ১২ বছরে পানির দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু এই সময়ে সেবা সংস্থাগুলোর সেবার মান খুব একটা বাড়েনি। কমেনি অনিয়ম-দুর্নীতি। এমন অবস্থায় দাম বাড়ানোর তোড়জোড়কে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার
সংশ্লিষ্টরা। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর আগামী ২১শে মার্চ থেকে গণশুনানির তারিখও ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
দেশে ইতিমধ্যে ডিজেলের দাম বাড়ায় সকল ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। তার উপরে আবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল দ্রব্যমূল্যে আরও একদফা উল্লম্ফন ঘটতে শুরু করেছে। করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের বিরাট একটি অংশ।
২০০৯ সালে দুই চুলার গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৪০০ টাকা। পাঁচ দফায় বেড়ে তা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি মাসে নতুন করে দুই চুলার গ্যাসের বিল ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ২০০৯ সালে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের খুচরা দাম ছিল চার টাকা ৩৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা ৯৬ পয়সা, বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। চলতি মাসে এই দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা।
ওদিকে গত ১১ বছরে সরকার ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৬ পয়সা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। এখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে সমপ্রতি জানানো হয়, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। থমকে যায় অর্থনীতির অগ্রযাত্রা। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় ধরনের দুর্যোগ দেখা দেবে। মূল্যবৃদ্ধির নিচে চাপা পড়া জনগণের জন্য তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দেবে।
লোকসান কমাতে দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও, গ্যাস ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারা প্রতি বছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার। গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে ফি বছর।
গত বছর নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর ৮ই নভেম্বর থেকে বাড়ে বাসের ভাড়া। তাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আগে থেকেই চাপে থাকা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আরও বাড়তি খরচের বোঝা চাপে। গত ১২ বছরে ছয়বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ফলে ২০০৯ সালের শেষেও যে ডিজেলের মূল্য ছিল ৪৪ টাকা লিটার, এখন তা হয়েছে ৮০ টাকা। দাম বেড়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে দিন দিন। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নজর না দিয়ে গ্যাস আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-অব্যস্থাপনা দূর না করে, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না নিয়ে দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ মূলত সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার নামান্তর।
গ্যাস, বিদ্যুতের পর পানির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্যাব-এর: গ্যাস, বিদ্যুতের পর পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সম্প্রতি ভার্চ্যুয়াল এক আলোচনায় সভায় সংগঠনটি এই প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, গত ১০ বছরে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ৩ গুণ। এরমধ্যেই বিদ্যুতের দাম ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর গ্যাসের অভাবে জ্বালানি তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। জ্বালানির সংকটে এলএনজি এনে তার দাম সমন্বয় করায় বিদ্যুতে খরচ আরও বাড়বে। যা বিবেচনায় রেখে ৬৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ড এসময় ৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এদের প্রত্যেকেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তারপরও তারা দাম বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে গ্যাস খাতে ভর্তুকি অনেক কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলা এখন লাভজনক অবস্থায় আছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে সিএনজির সঙ্গে সমন্বয় করে তারা লাভবান হয়েও ১১৭ শতাংশ মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এদিকে সঞ্চালন-বিতরণ কোম্পানিগুলোর সবাই লাভে থাকার পরও মূল্য বাড়াচ্ছে।
ক্যাব-এর নেতৃবৃন্দ বলেন, অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসা একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও সেবার চেয়ে বাণিজ্যের দিকেই এর নজর এখন বেশি।
করোনা মহামারির সময়েও ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক দফা বাড়ে দাম। এ দুই দফায় আবাসিকে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বেড়েছিল ৩ টাকা ৬১ পয়সা (৩১ শতাংশ)। বাণিজ্যিকে বেড়েছিল ৪ টাকা ৯৬ পয়সা (১৩ শতাংশ)। জনগণকে একটি অতিপ্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা আবারো ২০ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে চায় ঘাটতির টাকা তুলতে। অথচ সংস্থাটির অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করেই ঘাটতির টাকা সমন্বয় করা সম্ভব, মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রতিহাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা দেখিয়ে বলেছে তারা ১০ টাকা কমে ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। সরকার এই টাকা ভর্তুকি দেয়, যা আর দিতে চায় না।
ক্যাব বলেছে, প্রতিবার পানির দাম বৃদ্ধির সময় প্রচার করা হয় ভর্তুকির কথা। ভর্তুকির কারণ দেখানো হয় তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকে। সঙ্গে থাকে পানির স্তর নেমে যাওয়া। তথা খরচ বৃদ্ধিটা মূলতঃ গভীর নলকূপের খরচ। ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করে ৬৫ ভাগ। যার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়। বাকি ৩৫ ভাগ নদীর পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যয় প্রসঙ্গ উহ্য রাখা হয়। নন রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো চুরি বন্ধের কোনো উদ্যোগ সম্পর্কে থাকে না কোনো তথ্য। প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি এবং তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়। ঢাকা ওয়াসার ১১টি দুদক চিহ্নিত দুর্নীতি এবং সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো মাথাব্যথা দেখায়নি ওয়াসা।
ক্যাব-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা মূল্যবৃদ্ধি সইতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভর্তুকি সরকার আর দিতে পারছেন না। আমরা তার সঙ্গে সমস্বরে বলতে চাই, আমরা এই মূল্যবৃদ্ধি আর সইতে পারছি না। ওয়াসার এমডি এবং কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি এবং বোনাসের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিখাত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বিশেষের বেতন বাড়াতেই পারে। যাকে দিয়ে যত বেশি আয় করা সম্ভব, তার তত বেশি বেতন বাড়িয়ে তারা সেই ব্যক্তির কর্মদক্ষতা বাড়ায়। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি করা যদি তার (ঢাকা ওয়াসার এমডি) দক্ষতা হয় এবং সেই দক্ষতার পুরস্কারস্বরূপ যদি বেতন হয়, তাহলে আমাদের এই জায়গাটিতে আঘাত করতে হবে। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো সব সময় সরকারি এবং এর মালিক জনগণ। সরকার জনগণের পক্ষে কোম্পানির মালিকানা তদারকি করে। এখানে কোনো কোম্পানির বেতন-ভাতা সরকারি নিয়মের বাইরে হবে না, সরকারি নীতিমালা, সরকারি নিয়মের বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা হবে না, যারা পদাধিকার বলে এখানে বোর্ডের চেয়ারম্যান, তারা কোনো সভা করার ভাতা পাবেন না, কোনো টিএ-ডিএ থাকলে তা নিবেন সরকারের কাছ থেকে। কারণ সেখানে আমরা ট্যাক্স-ভ্যাট দেই। তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের মতো যে সমস্ত খাত লাভজনক নয়, যে সমস্ত খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে এবং সেই সমস্ত খাত সরকারি শুল্কমুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতে এক লাখ কোটি টাকার মতো মজুদ ছিল, যা সরকার আইন করে নিয়ে গেছে। জ্বালানি তেলের ৪৪ হাজার কোটি টাকা সমন্বয় না করে মুনাফা করেছে। এ ছাড়াও গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের বছরে এক দেড় হাজার কোটি টাকা ভোক্তারা দিচ্ছেন, কিন্তু সেই টাকা গ্যাস উন্নয়নে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেভাবে করে ব্যক্তিখাতে, ঠিক সেইভাবে সরকারি মালিকানাধীন এই কোম্পানিগুলো এই অর্থ তছরুপ করছে।
তথ্য সূত্র : mzamin