পদ্মা নদী পার হতে শরীয়তপুরের জাজিরার সাত্তার মাদবর মঙ্গল মাঝিকান্দি ঘাটে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। নদী পার হতে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক সময় দিনও পার হয়ে যায়। ঈদ এবং উৎসবে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ৩৫ বছর ধরে দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে জেলার লাখ লাখ মানুষকে। অবশেষে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার দিন শেষ হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বদলে যাচ্ছে ৩৫ বছরের পুরনো ঘাটের দৃশ্য। আশায় বুক বেঁধেছেন দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ।
ঘাট ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-জাজিরার সাত্তার মাদবর মঙ্গল মাঝিকান্দি ঘাট গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম নৌপথ। এই পথে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন পারাপার হয়। ঈদ, উৎসব এবং পদ্মায় নাব্য সংকট দেখা দিলে ঘাট ও ফেরি সংকটে ব্যাহত হয় যানবাহন পারাপার। এতে নদী পারের অপেক্ষায় মহাসড়কে আটকা পড়ে হাজারো যানবাহন। পদ্মা সেতু চালু হলে মাঝিকান্দি-শিমুলিয়া ঘাটে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরিতে যাত্রী এবং যানবাহনের চাপ কমে যাবে। অধিকাংশ যানবাহন সেতু দিয়ে চলাচল করবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ কমবে, বেঁচে যাবে সময়।
এদিকে, পদ্মা সেতু ঘিরে দুই প্রান্তের মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের জয় হওয়ায় সবার মাঝে আনন্দ বিরাজ করছে। এখন শুধু যাতায়াতের অপেক্ষা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্য ও পর্যটন প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে পদ্মা সেতু। সেদিন থেকেই সেতু দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন। এতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যাতায়াত ভোগান্তি ও খরচ কমবে। দ্বার উন্মোচন হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের।
তবে সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে গুরুত্ব কমবে নৌঘাটগুলোর। বদলে যাবে ঘাটের চিরচেনা দৃশ্য। ঘাটগুলোতে যাত্রী ও যানবাহনের উপচে পড়া ভিড় কমবে। তবে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরিগুলো আগের মতো চালু থাকবে।
শরীয়তপুরের বাসিন্দারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মাঝিকান্দি ঘাটের গুরুত্ব কমবে। আগের চিরচেনা ভিড় থাকবে না। সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে সড়কপথে। দূর হবে যুগযুগের ভোগান্তি। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষ এতদিন উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছিল। এবার উন্নয়নের হাওয়া লাগবে। বদলে যাবে জীবনযাত্রা।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি-মাঝিকান্দি নৌপথে ৮৭টি লঞ্চ, ১০টি ফেরি ও ১২৫টি স্পিডবোট চলাচল করছে। এর মধ্যে জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথে ২০টি লঞ্চ, ৩০টি স্পিডবোট ও ১০টি ফেরি চলাচল করছে। এসব নৌযানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নদী পার হন। ঘাট ও যাত্রীদের ঘিরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। ৩০টির বেশি হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় দেড় শতাধিক দোকান রয়েছে। দোকান ছাড়াও পান, সিগারেট, ঝালমুড়ি, বাদাম, ছোলা, আচার, শিঙাড়া, চানাচুর নারিকেল চিড়া, শসা ও দইসহ নানা খাবারের ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা রয়েছেন তিন শতাধিক।
মাঝিকান্দি ঘাটের ব্যবসায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা বলছেন, সেতু চালু হওয়া আনন্দের খবর। সেতু ঘিরে আনন্দের বন্যা বইছে। সেতু চালু হলে আমাদের ব্যবসা কিছুটা কমবে। কারণ যাত্রীদের চাপ কমবে। এটাই বাস্তবতা। তবে খুশির খবর হলো, সেতু ঘিরে নতুন নতুন ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠবে। অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে। আমরা নতুন পেশা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।
এরই মধ্যে সেতু ঘিরে পদ্মাপাড়ে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। গ্রামীণ বাজার তৈরি হওয়াসহ এলাকার অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। পদ্মাপাড়ের নদীশাসন বাঁধসহ সেতু এলাকায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসব পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে আসেন। সেক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের নতুন পথ খুলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জাজিরার নাওডোবা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদের ও ইউসুফ সরদার জানান, দীর্ঘ ২০ ধরে ফেরিঘাটে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। এই ব্যবসা করে গরু-ছাগলের খামার দিয়েছেন। সেতু চালু হলে নতুন ব্যবসা শুরু করবেন তারা। সেক্ষেত্রে বদলে যাবে তাদের জীবনমান।
ঘাটের ভ্রাম্যমাণ দোকানি আবুল কালাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ঘাটে হকারির ব্যবসা করি। সেতু চালু হওয়ায় আমরা খুশি। সেতু চালু হওয়ার ফলে ঘাটে যাত্রীদের চাপ কমলে নতুন ব্যবসা শুরু করবো।’
মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘১০ বছর ধরে মাঝিকান্দি ঘাটে মাঠা ও মিষ্টি দই বিক্রি করে আসছি। আমার মনে হয়, সেতু চালু হলে যাত্রী কমলেও বেচাকেনা কমবে না। কারণ সবাই তো আর সেতু দিয়ে যাবে না। লঞ্চেও মানুষজন চলাচল করবে। ব্যবসা-বাণিজ্য আগের মতোই থাকবে।’
গোসাইরহাটের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমি মিরপুরে পোশাকের ব্যবসা করি। গত ১০ বছর ধরে সপ্তাহে একবার গ্রামের বাড়ি গোসাইরহাটে আসি। মিরপুর থেকে থেকে সড়কপথে মাওয়া দিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে হয়। দীর্ঘ সময় লঞ্চ ও ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেতু চালু হলে সরাসরি সড়কপথে বাড়ি আসবো। ভোগান্তি কমে যাবে। এজন্য আমি আনন্দিত।’
ডামুড্যা উপজেলার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাওয়া থেকে মাঝিকান্দি ঘাটে লঞ্চ কিংবা স্পিডবোটে যেতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এই কষ্টের দিন শেষ হচ্ছে আমাদের। লঞ্চে ৬০ টাকা, স্পিডবোটে ২০০ টাকা লাগে ভাড়া। যাত্রীদের ভিড় থাকলে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নিতো স্পিডবোট চালকরা। পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে আমাদের এই কষ্ট ও দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
মাঝিকান্দি ঘাটের লঞ্চের মাস্টার মো. হান্নান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে জেনে আমরা আনন্দিত। এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে। ১৫ বছর ধরে লঞ্চ চালাই। সেতু চালু হলে উন্নয়ন হবে। আমাদের ভাগ্যের বদল হবে। আমরা এই অঞ্চলের উন্নয়ন চাই।’
মাঝিকান্দি ঘাটের লঞ্চ চালক আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা লঞ্চের চালক ও স্টাফরা অন্য কোনও কাজ শিখিনি। সেতু চালু হলে যাত্রী কমলে নতুন নৌপথ চালু করতে হবে। তবে লঞ্চের যাত্রী তেমন কমবে না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) মাঝিকান্দি ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক ভোজন সাহা বলেন, ‘সেতু চালু হলে ফেরি চলাচল বন্ধ হবে কিনা এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে লঞ্চ, ফেরি এবং স্পিডবোট চালু রয়েছে। সেতু চালু হলে ঘাটে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ বিভিন্ন উপজেলার যাত্রীরা লঞ্চেই যাতায়াত করবেন। তবে যাত্রী কিছুটা কমতে পারে। এক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়বে না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) মাঝিকান্দি ঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক আব্দুল্লাহ ইনাম বলেন, ‘তিন নৌপথে ৮৭টি লঞ্চ, ১২৫টি স্পিডবোট ও ১০টি ফেরি চলাচল করছে। পদ্মা সেতু চালু হলে ঘাট চালু থাকবে। যাত্রী কমলে তখন বিকল্প চিন্তা করা হবে।’