বন্দর নগর চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি সংক্রান্ত ‘সিরোপ্রিভালেন্স অব সার্স-২ কোভিড-১৯ অ্যান্টিবডি ইন চিটাগাং, বাংলাদেশ : এ ক্রসসেকশনাল স্ট্যাডি’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করোনায় আক্রান্ত ও আক্রান্ত নয় এমন এক হাজার ৫৩০ জনের মধ্যে ৬৫ শতাংশের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষভাবে আরটিপিসিআর পজিটিভ অর্থাৎ করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। এছাড়াও আরটিপিসিআর নেগেটিভ এমন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির রয়েছে।
শনিবার (৮ মে) চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও উপসর্গযুক্ত রোগীদের শরীরে করোনাবিরোধী অ্যান্টিবডির উপস্থিতি ও এর স্থায়িত্ব অনুসন্ধান করার উদ্দেশে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। একইসঙ্গে রোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের মধ্যে কী কী উপসর্গ বিদ্যমান ছিল এবং করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরও কোনো ধরনের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা রয়ে গেছে কি-না, এসব তথ্য আহরণ করা ইত্যাদি ছিল এ গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হয় এ গবেষণা। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চলমান এ গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের এক হাজার ৫৩০ জন (আরটিপিসিআর পজিটিভ-৯৪১; আরটিপিসিআর নেগেটিভ-৫৮৯) ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গবেষণা পরিচালনা দলের প্রধান ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আব্দুর রব বলেন, ‘এই গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অধিকাংশ পুরুষ (৭৫ শতাংশ) এবং চাকরিজীবী (৭০ শতাংশ)। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের প্রধান লক্ষণগুলো ছিল জ্বর (৯২ শতাংশ), কাশি (৬৩ শতাংশ) এবং ঘ্রাণশক্তি লোপ (৫২ শতাংশ)। এছাড়াও গলাব্যথা, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গও ছিল। আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর অনেকেই আগে থেকে ডায়াবেটিস (১৫ শতাংশ), উচ্চরক্তচাপ (২৩ শতাংশ), শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা (৯ শতাংশ), হৃদরোগ ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ছিল।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর তাদের প্রায় ৫৭ শতাংশের কোনো না কোনো উপসর্গ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা, ব্যথা, দুশ্চিন্তা, অবসাদ, কাশি, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষভাবে আরটিপিসিআর পজিটিভ রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। এছাড়াও আরটিপিসিআর নেগেটিভ এমন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে।
ডা. মো. আব্দুর রবের নেতৃত্বে গবেষণা পরিচালনায় অংশ নেন, জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান, গবেষণা সহযোগী ডা. এম এ কবির চৌধুরী, সিভিল সার্জন অফিসের সহকারী সার্জন ডা. অমি দেব ও এমিন্যান্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা ডা. মোরতাহিনা রশিদ।
প্রধান গবেষক ডা. মো. আব্দুর রব বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছি। করোনাভাইরাসকে আরও বিশদভাবে জানার লক্ষ্যে রোগীদের লক্ষণ, সেরে ওঠার পর দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নিয়ে এই গবেষণা অত্যন্ত সময়োপযোগী।’
গবেষণা কমিটির সমন্বয়ক ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের দেশের বাস্তবতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানকে উন্নত করার জন্য এ ধরনের গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জানামতে, জেলা পর্যায়ের কোনো হাসপাতালে নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণার এটিই প্রথম উদাহরণ। আমরা আশা করি, আমাদের এই উদ্যোগ চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত গবেষণা কর্মকে উৎসাহিত করবে।’
সংগৃহীত তথ্যের আলোকে ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘এই গবেষণার অন্যতম সাফল্য হলো আক্রান্ত রোগীদের একটি বড় অংশকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তাদেরকে সরাসরি ইন্টারভিউ ও পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগৃহীত হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল সরকারের চলমান কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচিকে আরও গ্রহণযোগ্য ও গতিশীল করবে।’
তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ডা. এম এ কবির চৌধুরী জানান, ‘গবেষণায় সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পেয়েছি। যেমন- ছয় মাসের অধিক সময় পর্যন্ত আরটিপিসিআর পজিটিভ রোগীদের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি। এসব তথ্যসমূহ আরও বিশদে বিশ্লেষণ করে আমরা যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক জার্নালে উপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। যা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমুন্নত করবে।’
গবেষণা ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- শিক্ষা উপমন্ত্রী ও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
তিনি বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস আসার পর চট্টগ্রামে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সর্বপ্রথম একমাত্র ভরসাস্থল ছিল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল। প্রথমাবস্থায় কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট থাকলেও বর্তমানে পরিপূর্ণ। গবেষণাটি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। অ্যান্টিবডি গবেষণায় ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে।’