চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা: মেয়র ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
বাংলাদেশ

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা: মেয়র ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

সামান্য বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে চট্টগ্রম নগরী। এবার নগরীতে জলাবদ্ধতা যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, তা অতীতে কখনও দেখেনি নগরবাসী। টানা চার দিনের বৃষ্টিতে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসীর মনে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।

নগরীর এই জলাবদ্ধতা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এখন মুখোমুখি অবস্থানে। জলাবদ্ধতা ও দুর্ভোগের জন্য দুই সংস্থা একে অপরকে দোষারোপে ব্যস্ত। এ যেন ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা।

গত ৪ থেকে ৭ আগস্ট চার দিন টানা বৃষ্টিপাত হয়। এতে নগরীর ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। অন্তত ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এ দুর্ভোগ থেকে বাদ যায়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়িও। জলাবদ্ধতার পানি তার বাড়িতেও ঢুকেছে।

চসিক-সিডিএ বিরোধ শুরু যেভাবে

জলাবদ্ধতার দ্বিতীয় দিনে শনিবার (৫ আগস্ট) দুপুরে  রিকশায় চড়ে নিজ বাড়িতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মানুষ সিটি করপোরেশনকে গালিগালাজ করছে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের কোনও হাত নেই। আমি বলেছি, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য। এ পর্যন্ত কোনও দিন কোনও কাউন্সিলরকে ডাকেনি সিডিএ।’

মেয়র অভিযোগ করে বলেন, ‘সিডিএ বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যোগ্য নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএ’র গাফিলতি রয়েছে।’

এ নিয়ে গত ৬ আগস্ট মেয়র মো. রেজাউল করিম তার ব্যবহৃত ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ওপর থেকে ময়লা পরিষ্কার করে দিলাম, কতগুলো পলিথিন পরিষ্কার করে দিলাম, সেটাকে তো খাল পরিষ্কার বলা যাবে না। মাটি উত্তোলন করতে হবে। যত দোষ নন্দ ঘোষ, সব মেয়রের দোষ। কিন্তু এ মেগা প্রকল্পে তো মেয়রের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। এ প্রকল্পে কিছু করার মতো ক্ষমতাও নেই মেয়রের।’

‘শুধু খালের দুই পাড়ে দেয়াল দিলে হবে না। খাল থেকে মাটি তুলতে হবে। প্রকল্পের ডিপিপিতে ৯ দশমিক ৫ (১১ লাখ কিউবেক মিটার) মাটি উত্তোলনের কথা লেখা আছে। সে পরিমাণ মাটি তুলেছে? মাটি উত্তোলন করা না হলে প্রকল্পের সাফল্য আসবে না।’

‘যে ওয়ার্ডের কাজ (মেগা প্রকল্পের) করবে, ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে বলেছি। তারা (সিডিএ) তো করপোরেশনকে কোনও কিছু জানায়নি। তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করছে। এত বড় প্রকল্প, চট্টগ্রামবাসীর বাঁচা-মরার প্রশ্ন, এরপরও তারা সমন্বয় করছে না।’—লেখেন মেয়র।

পানি ভবনের আঙ্গিনা ডুবে আছে পানিতে চসিক মেয়রের অভিযোগের জবাবে বুধবার (৯ আগস্ট) সংবাদ সম্মেলনে সিডিএর চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘চসিক মেয়র ভুল তথ্য দিয়ে সিডিএ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ সিডিএ’র না। সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতার কাজ ঠিকভাবে করতে না পারায় সিডিএকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ করছি। প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএ’র কোনও গাফিলতি নেই। কাজ চলমান আছে। প্রকল্পের আওতায় থাকা খালে কোনও ময়লা নেই, পরিষ্কার রয়েছে। নালা-ড্রেন পরিষ্কার না করায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নালা-ড্রেন পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব তো সিটি করপোরেশনের। যেটা সত্য, সেটাই বলছি। আমরা কাউকে দোষারোপ করছি না।’

সিডিএ চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের জবাবে বুধবার বিকালে মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন আরেকজনকে দোষারোপ করার সংস্কৃতিতে আমি বিশ্বাস করি না। জলাবদ্ধতা হচ্ছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। মানুষ আমাকে ও কাউন্সিলরদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। অন্য কোনও সংস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। তাই ভালোমন্দ হলে মানুষ আঙুল তোলে মেয়রের দিকে। তারা গালি দেয়, সুনামও করে। এটা তাদের অধিকার।’

মেয়র বলেন, ‘আমি কাউকে দোষারোপ করবো না। কিন্তু সিডিএ’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার একজন সরকারি কর্মচারী। উনি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরদের প্রতি আঙুল উঁচু করে কথা বলতে পারেন না। সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করতে পারে না। উনি কোন জরিপের ওপর ভিত্তি করে বলছেন যে, নালাগুলো ভরাট তাই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। উনি কি জরিপ চালিয়েছেন? অনুমান করে কাউকে দোষারোপ করা সমীচীন নয়। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সিটি করপোরেশনের হাতে নেই।’

ভুক্তভোগী নগরবাসী যা বলছেন

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মইন উদ্দিন বলেন, আগে জলাবদ্ধতা হলে বহদ্দারহাট এলাকায় হাঁটুপানি হলেও এবার কোমর থেকে বুকসমান পানিতে ডুবেছে বহদ্দারহাট। যেখানে আগে পানি ওঠেনি, সেসব অলিগলি, সড়ক ছাড়িয়ে অধিকাংশ বাসা-বাড়ির নিচতলা ডুবে গেছে।

বাকলিয়া থানাধীন মাস্টারপুল এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুল আলম বলেন, এবারের মতো নগরীতে জলাবদ্ধতা অতীতে কখনও দেখিনি। পুরো চার দিনই বাকলিয়াসহ আশপাশের অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। অধিকাংশ ঘরের চুলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ কারণে ঘরে রান্না হয়নি। পানিবন্দি মানুষগুলোকে দেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা।

জলাবদ্ধতার কারণে নগরীতে যানজট চকবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ওয়াসিম বলেন, চকবাজারের জলাবদ্ধতা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অথচ নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান। এক টাকারও সুফল পাচ্ছে না কেউ। বরং জলাবদ্ধতা বেড়েছে। সিডিএ’র কতিপয় কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে পাহাড়ে, পুকুর-ডোবায়, নালার ওপরসহ যত্রতত্র অবৈধভাবে ভবন করার অনুমতি দিচ্ছে। এ কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে নগরীতে জলাবদ্ধতা বাড়ছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্প

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরায় খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন শীর্ষক সিডিএ’র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। বাকি তিন প্রকল্পের মধ্যে ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

দুই হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকার কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাকতাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এ ছাড়া এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিটি করপোরেশন।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬ খাল নিয়ে এ প্রকল্প। এর মধ্যে ১৬ খালের সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ৯টি খালের কাজ শেষ পর্যায়ে। বাকি ১১টি খালের কাজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে শেষ করা যাচ্ছে না।’

পানিতে ডুবে গেছে নগরীর অলিগলিও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দোষারোপের সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত। ২০১৭ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকার প্রকল্পটি সিডিএকে বাস্তবায়নের জন্য সরকার দিয়েছিল। তখন থেকে সিটি করপোরেশনের সহ্য হচ্ছিল না। কেননা, মেগা প্রকল্প মানেই মেগা লাভ।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়র বলেছেন, খাল-নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব তাদের না। এটা অবান্তর কথা। সিডিএ’র দায়িত্ব অবকাঠামো তৈরি করে চসিককে হস্তান্তর করা। চসিক এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এ সংস্থাগুলোর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। সবাই হরিলুটে ব্যস্ত। একে অন্যের সমন্বয় নেই। সমন্বয় সভা হলেও সেখানে অন্য সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন না। সমন্বয় সভায় এমন প্রতিনিধি পাঠানো হয়, যাদের মতামত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা শুনে চা-নাশতা খেয়ে চলে যান। কোনও মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ সভা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাহলে গুরুত্ব বাড়বে।’

সুজন সম্পাদক আরও বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, জবাবদিহি না থাকা এবং তাদের দায়িত্ব পালন না করার কারণে চট্টগ্রাম নগরী বারবার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চসিক নগর পরিষ্কার রাখতে জনগণের কাছ থেকে ৭ শতাংশ ট্যাক্স নিচ্ছে। কিন্তু তারা নগর কতটা পরিষ্কার রাখছে?’

রিকশায় চড়ে নগরী পরিদর্শনে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী গত ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন যৌথ বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে মেগা প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছেন, তা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চসিক মেয়র এবং সিডিএর চেয়ারম্যানের অধীনে চলমান প্রকল্পগুলো যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়। একে অপরের প্রতি দোষারোপ না করে কাজ শেষ করলে এর সুফল জনগণ ভোগ করবে। এতে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি সুরক্ষিত হবে।

৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্কর বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং সিডিএর ব্যর্থতার কারণে নগরবাসী জলাবদ্ধতায় কষ্ট পাচ্ছে। কারণ জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পসহ দুটি প্রকল্প চলমান আছে সিডিএ’র। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প দুটির কাজ শেষ না করে ব্যর্থ হয়েছে সিডিএ। আবার সিটি করপোরেশন দীর্ঘ ৯ বছরেও বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত একটি নতুন খাল খনন কাজ শেষ করতে পারেনি। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সংস্থাটি ঠিকমতো নালা-নর্দমাও পরিষ্কার করেনি। তাই মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।

Source link

Related posts

কিশোরগঞ্জে ২৫ বছর পর উপজেলা আ.লীগের সম্মেলন

News Desk

আবারও বৃষ্টিতে দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসিদের

News Desk

সড়ক দুর্ঘটনা-যানজটে বছরে ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা

News Desk

Leave a Comment