চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ২৫০ মৃত্যু, ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি
বাংলাদেশ

চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ২৫০ মৃত্যু, ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি

চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামজুড়ে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল। সর্বশেষ রবিবার (২৭ আগস্ট) সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ওই এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল (৩৫) ও তার সাত মাস বয়সী মেয়ে জান্নাত মাটিচাপা পড়ে মারা যান। 

এভাবে গত ১৭ বছরে জেলায় পাহাড়ধসে ও মাটিচাপায় ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকে। জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। 

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘চলতি বছর পাহাড় কাটার অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাহাড় কাটায় জড়িতরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদেরকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কোনও কোনও স্থানে পাহাড় কাটার কারণে ধসের ঘটনা ঘটে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেটওয়ার্ক প্রতিনিধি ও সাংবাদিক আলিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধসে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড়ধসে একসঙ্গে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ঘটনার পর ওই বছর বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা রোধে ‘শক্তিশালী পাহাড় রক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে কমিটি চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের জন্য ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে ৩৬টি সুপারিশ করলেও তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশগুলো গত ১৬ বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় থামছে না পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল।’

৩৬ সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, জরুরি বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ, মতিঝরনা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নগরীকে পাহাড়ি এলাকা হাটহাজারীর দিকে সম্প্রসারণ না করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে পটিয়া ও আনোয়ারার দিকে সম্প্রসারণ। গত ১৬ বছরে বাস্তবায়িত হয়নি এর একটি সুপারিশও।

২৭ আগস্ট পাহাড়ধসে বাবা-মেয়ের মৃত্যুর পর আবারও ঘুম ভেঙেছে জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর ও সহকারী কমিশনার হুছাইন মুহাম্মদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর ষোলশহর রেলওয়ে কলোনিতে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ধস এড়াতে নগরীর বিভিন্ন ঝৃঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে লোকজনকে সরে যেতে রবিবার সকাল থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ এপ্রিল বিকালে নগরীর আকবরশাহ থানার বেলতলিঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মারা যান মো. মজিবুর রহমান খোকা (৪৫) নামে এক শ্রমিক। ওই এলাকায় সড়ক নির্মাণে ব্যাপকহারে পাহাড় কাটার সময় ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও তিন জন আহত হন। 

এর আগে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই বছর ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝরনা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছিল। ওই দিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড়ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান তিন জন। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মা-মেয়ে। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর আকবরশাহ থানার ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় পাহাড়ধসে এক শিশু প্রাণ হারায়। ২০২২ সালের ১৭ জুন পাহাড়ধসে মারা যান আরও চার জন। ওই দিন রাত ২টায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও পাঁচ জন আহত হন।

এত প্রাণহানির পরও চট্টগ্রাম নগরীতে বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা, দখল ও বসতি স্থাপনা। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও ১২১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সবমিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৭ বছরে নগরী ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জেলা পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপ-কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, নগরীর ২৫টি পাহাড়ে এক হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বললেও যায় না।

সুপারিশগুলো গত ১৬ বছরেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল

জেলা প্রশাসন জানায়, গত ৮ আগস্ট পাহাড় রক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৭তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত সভায় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগদানে সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে হবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ের বিষয়ে কিছুই বলার নেই আমার। তবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পাহাড় মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি-বেসরকারি পাহাড় দখলদার উচ্ছেদ করার পর, যাতে বেদখল না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

পাহাড়ে বসবাসকারীদের ৮০ শতাংশ ভাড়াটিয়া উল্লেখ করে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের তালিকা করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল মালিক কাকে ভাড়া দিয়েছে, ভাড়ার শর্ত মানা হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিং করতে হবে। পাহাড় কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশ মামলা এবং জেল-জরিমানা করতে পারে।’

Source link

Related posts

৭০ বছরেও স্বীকৃতি পাননি চাঁদপুরের ৪০ ভাষা সংগ্রামী

News Desk

উনি কিছু দিন ধরে প্রলাপ বকছেন: মির্জা আব্বাস

News Desk

বলয়গ্রাস সূর্যগ্রহণ আজ

News Desk

Leave a Comment