কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত আট জন চট্টগ্রামের তিন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন। এর মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। একজনের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই আট জনের মধ্যে সাত জনই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে সংঘর্ষ। এতে তিন জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হন। আহতদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮০ জনের বেশি চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭১ জনের নাম রেজিস্ট্রি খাতায় উল্লেখ করা আছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ৪০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, কয়েকজন ভর্তি আছেন। এর বাইরে নগরীর ন্যাশনাল হাসপাতাল, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য ক্লিনিকে আহত অনেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আহতদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন সুদীপ্ত পাল, পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন মেহেদী হাসান, জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ জুবায়ের, মো. আলমগীর হোসেন, মো. ইকবাল হোসেন, মো. সোহেল, শ্রাবণ এবং ন্যাশনাল হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন হিমান ঘোষ। তাদের মধ্যে ইকবালের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। জালাল উদ্দিনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক হওয়ায় ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে তার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ, নড়াচড়া করানো না যাওয়ায় তাকে সেখানে রাখা হয়েছে।
আইসিইউতে থাকা সাত জনই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য নুরুল আজিম রনি। তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষে আমাদের অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৩ জন। এ ছাড়া পার্কভিউ ও ন্যাশনাল হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে আরও ২০ জনের মতো নেতাকর্মী চিকিৎসা নিয়েছেন। আরও কয়েকজন ভর্তি আছেন।’
আইসিইউতে থাকা সাত জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে রনি বলেন, ‘এর মধ্যে একজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন বাকিদের অবস্থাও খুব খারাপ।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ৮০ জনের বেশি আহত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানালেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দিন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘৭১ জনের নাম এন্ট্রি করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক অনেকের নাম এন্ট্রি করা যায়নি। বর্তমানে ১১ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে একজন আইসিইউতে, দুজন ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে, দুজন নিউরো সার্জারিতে, তিন জন অর্থোপেডিক সার্জারি অ্যান্ড ট্রমালোজিতে এবং তিন জন অন্যান্য ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’
পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিকিৎসক রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংঘর্ষে আহত ৪০ জনের মতো আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আছেন। অধিকাংশকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহত ১৫ জন বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন। ছয় জন আইসিইউতে ছিলেন। এর মধ্যে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় আইসিইউতে থাকা একজনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হয়তো তাদেরও ঢাকায় পাঠাতে হবে।’
সংঘর্ষের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার দুটি থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি প্রায় সাড়ে সাত হাজার। এর মধ্যে পাঁচলাইশ থানায় তিনটি এবং খুলশী থানায় একটি। আরও মামলা হবে। সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে বহদ্দারহাট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত। কয়েক কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আহত হয়ে আন্দোলনকারীরা সেখান থেকে সরে গেলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
সংঘর্ষে তিন জন নিহত এবং দেড় শতাধিক আহত হন। নিহতরা হলেন মো. ওমর ফারুক (৩২), ওয়াসিম আকরাম (২৩) ও ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২৪)। ফারুক স্থানীয় একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী এবং কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মো. দুলালের ছেলে। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে। ফয়সাল চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। তিনি বরিশালের রহমতপুর থানার জাকির হোসেনের ছেলে।