চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ চৌধুরীহাট এলাকার যুবক রায়হান উদ্দিন (২১)। রবিবার (৩ নভেম্বর) থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ৫০ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রায়হান উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে আমি জ্বরে আক্রান্ত। শনিবার চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই। এতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রবিবার চমেক হাসপাতালে ভর্তি হই।’
রায়হান উদ্দিনের মতো চট্টগ্রামে চলতি বছর ৩ হাজার ২৪৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে চমেক হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি হন ৬২০ জন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘চট্টগ্রামে দিন দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যে কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য চমেক হাসপাতালে পৃথক একটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ওই ওয়ার্ডে ২২ জন রোগী ভর্তি ছিল।’
চমেক হাসপাতাল ডেঙ্গু ওয়ার্ড সূত্র জানিয়েছে, ‘চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর চমেক হাসপাতাল ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করা হয়। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত এ ওয়ার্ডে ৬২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ৩৭০ জন পুরুষ এবং ২৫০ জন নারী। আক্রান্তদের মধ্যে চার জন পুরুষসহ পাঁচ জন রোগী আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ২৪ জন ডেঙ্গু রোগী।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে চলতি বছর ৩ হাজার ২৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ ১ হাজার ৭৬১ জন, নারী ৮৯৮ জন এবং শিশু ৫৮৫ জন। চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ ১১ জন, নারী ১৫ এবং শিশু ৩ জন।’
চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ২৯ জনের মধ্যে নভেম্বরে ৪ জন, অক্টোবরে ৯, সেপ্টেম্বরে ১১, আগস্টে ১, জুলাইয়ে ১, মার্চে ১ এবং জানুয়ারিতে ২ জন মারা গেছেন।
তিনি জানান, পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৯ জন, ২০২৩ সালে ১০৭ জন, ২০২২ সালে ৪১ জন এবং ২০২১ সালে ৫ জন। উপজেলা পর্যায়েও ডেঙ্গু বাড়ছে। এরমধ্যে লোহাগাড়ায় ২০০ জন, সাতকানিয়ায় ১৪২ জন, সীতাকুণ্ডে ১৫১ জন, রাউজানে ১১৭ জন, পটিয়ায় ৭৮ জন, চন্দনাইশে ৭৬ জন, বাঁশখালীতে ৭৩ জন, কর্ণফুলীতে ৫৫ জন, হাটহাজারীতে ৫১ জন, বোয়ালখালীতে ৪৮ জন ও ফটিকছড়িতে ৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিকে, মহানগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৭টি এলাকাকে রেড জোন, ৫টি এলাকাকে হলুদ, ৭টি এলাকাকে নীল ও ৪টি এলাকাকে সবুজ জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ৭টি এলাকার মধ্যে রয়েছে- কোতোয়ালি, বাকলিয়া, বায়েজিদ, বন্দর, পাহাড়তলী, খুলশী ও চকবাজার থানা এলাকা।
জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদাওছ বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে এসব এলাকাকে আমরা চিহ্নিত করেছি। এরমধ্যে ৭টি এলাকাকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৫টি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে এই তালিকা সিটি করপোরেশনকে দিয়েছি।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর বাড়ছে। ডেঙ্গু কমাতে হলে মশা নিধনের বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে যেসব এলাকায় বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে সে তালিকা সিটি করপোরেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলোতে মশা নিধনে বেশি নজর দেওয়ার জন্য বলেছি।’
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন বুধবার (৬ নভেম্বর) ডেঙ্গু নিয়ে করপোরেশনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন তিনি। এতে ডা. শাহাদাত বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যাগে মেমন মাতৃসদন হাসপাতালে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেল গড়ে তোলা হবে। স্বল্প খরচে বিশেষজ্ঞসহ ডেঙ্গু রোগীদের রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট পরিদর্শন করবো আমি।’
চসিক মেয়র আরও বলেন, ‘মশা মারতে এখন যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোও আমি যাচাই করবো, সেগুলো আসলে কাজ করছে কিনা। প্রয়োজনে মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন ওষুধ ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করবো।’
চট্টগ্রামে গত এক সপ্তাহে (শুক্র থেকে বৃহস্পতিবার) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০৯ জন। এরমধ্যে শুক্রবার ৪৩ জন, শনিবার ১৯ জন, রবিবার ৪৯ জন, সোমবার ৫২ জন, মঙ্গলবার ৫৬ জন, বুধবার ৩৭ জন ও বৃহস্পতিবার ৫৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।