চর ও চরের শিশুদের নিয়ে ‘চমৎকার’ যত উদ্যোগ
বাংলাদেশ

চর ও চরের শিশুদের নিয়ে ‘চমৎকার’ যত উদ্যোগ

ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপচর কালির আলগা। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্গম এই চরে নৌযান ছাড়া যাতায়াতের ভিন্ন কোনও পথ নেই। চরটিতে প্রায় তিন হাজার মানুষের বসবাস। এই চরের শিশুদের জন্য ছিল না কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৌযাত্রার ঝুঁকি নিয়ে দূরের স্কুলে শিশুদের পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন না অভিভাবকরা। ফল, শৈশব পেরুনোর মাথায় মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ে আর ছেলেদের শিশুশ্রম!

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের আলোকজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে শিক্ষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। প্রতিষ্ঠিত এই সত্যকে ধারণ করে সদর উপজেলা প্রশাসন ব্রহ্মপুত্রের কালির আলগা চরে প্রতিষ্ঠা করেছে ‘উপজেলা প্রশাসন বিদ্যানিকেতন’ স্কুল। চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে আনুষ্ঠানিক শ্রেণিপাঠ শুরু করেছে স্কুলটি। অভিভাবকরা যেন দ্বীপচরে একটি বাতিঘর পেয়েছেন! এর আগে ২০২২ সালে ব্রহ্মপুত্রের চর ভগবতীপুর গ্রামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে উপজেলা প্রশাসন।

এমনটাই জানান কালির আলগা গ্রামের বাসিন্দা সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমগো এইহানে স্কুল আছিল না। অগইত্যা বাল্যবিবাহ দিতে হইতো। অহন উপজেলা থাইকা স্কুল কইরা দিছে। বাচ্চাগো নিয়া চিন্তা দূর হইছে। তারা সুন্দর পড়তে পারতাছে, খেলতে পারতাছে। চরে স্কুল খুব জরুরি।’

শুধু স্কুল নয়, চরাঞ্চলের শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য স্কুলমাঠে নিয়মিত খেলাধুলার জন্য দেওয়া হয়েছে উপকরণ। এ ছাড়াও সদরের ⁠চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে হাইজিন কিট এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হাইজিন সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এমন সব উদ্যোগকে ‘চমৎকার’ বলছেন সুবিধাভোগীরা।

কালির আলগার বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম জানান, বন্যা হলে চর প্লাবিত হয়। কেউ মারা গেলে কবর দিতে সমস্যা হয়। নদী পাড়ি দিয়ে অন্য চর কিংবা মূল ভূখণ্ডে গিয়ে কবর দিতে হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুসফিকুল আলম হালিম সমস্যার কথা জানতে পেরে চরের একদিকে একটি জায়গায় বালু ভরাট করে উঁচু করে কবরস্থান তৈরি করে দিয়েছেন। এতে কবরস্থান সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে।

শুধু কালির আলগা গ্রাম নয়, পাঁচগাছী ইউনিয়নের ধরলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী শতাধিক পরিবার ও তাদের প্রতিবেশীদের জন্য ‘জান্নাতুল বাকি’ কবরস্থান নির্মাণ করেছে উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে ডব্লিউএফপির সহযোগিতায় প্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি ব্যয় ধরে বিভিন্ন চরে ভিটে উঁচু করাসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন করে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এবং বই ও খেলাধুলা সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সদরের ধরলা আববাহিকার হলোখানা ইউনিয়নে নূরনবী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন চরের শিক্ষার্থীদের নৌপথে বিনাখরচে স্কুলে যাতায়াত এবং দুর্যোগকালে উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ বিতরণের সুবিধার্থে উপজেলা প্রশাসন থেকে ‘স্বপ্নতরী’ নামে একটি নৌকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নিয়মিত চলছে নৌকাটি।

চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আলোচনা সভা ও খেলাধুলার আয়োজন এবং বনায়নের লক্ষ্যে স্থানীয়দের মাঝে ফলজ ও বনজ বৃক্ষের চারা বিতরণসহ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চরের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রকৃতিক দুর্যোগে চরাঞ্চলের মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে।

চর নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের প্রশংসিত ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ঘোড়ার প্রতি নিষ্ঠুরতা পরিহারের উদ্যোগ। চরাঞ্চলে মালামাল পরিবহনে অন্যতম প্রধান বাহন ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু ঘাড়ে লোহার শ্যাফটের ব্যবহার ঘোড়ার প্রতি নিষ্ঠুরতা শামিল মনে করেন ইউএনও মুসফিকুল আলম হালিম। প্রাণীটির প্রতি মানবিক হতে গাড়ির চালকদের নিয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন তিনি। সদরের যাত্রাপুর ও হলোখানা ইউনিয়নে প্রায় আড়াই শতাধিক ঘোড়ার গাড়ির চালকদের সঙ্গে সচেতনতামূলক সভা করেন। ঘোড়া যাতে কষ্ট না পায় এজন্য লোহার শেফটের ওপর ফোম ও চামড়া দিয়ে সেলাই করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে ঘোড়া ও মালিকদের দেওয়া হয় খাদ্য সহায়তা।

বিদায়ী ইউএনও মুসফিকুল আলম হালিম বলেন, ‘বন্যা ও প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতায় চরাঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকেন। নদীর প্রবাহে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চরের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য চরের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়াও চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বদলিজনিত কারণে আমি চলে গেলেও আমার পরবর্তী দায়িত্বশীলরা এসব কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল একদিন সারা দেশের জন্য মডেল হবে বলে বিশ্বাস করি।’

Source link

Related posts

আগুনে ঘর হারানো ৫ হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে, শীতে মানবেতর জীবন

News Desk

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণ

News Desk

উত্তরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা

News Desk

Leave a Comment