‘কাল সারা রাত গরুটি অঝোর ধারায় কেঁদেছে। যতবারই এসেছি, দেখছি তার দুই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।’ বলছিলেন যশোর সদরের ঝাউদিয়া গ্রামের গৃহবধূ জেসমিন খাতুন (২৭)।
কোরবানির জন্য প্রস্তুত গরুটি গত শুক্রবার (১৪ জুন) সকালে সরেজমিনে দেখতে যান সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক। এর আগের দিন গরুটি ‘বায়না’ দিয়ে আসেন যশোর শহরের পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া এলাকার মনিরুজ্জামানের বড় ছেলে মাহমুদ উজ জামান।
ঝাউদিয়া গ্রামের আব্দুল জলিল ও জেসমিন খাতুন দম্পতি আদর করে তাদের গরুটির নাম রেখেছেন ‘লালবাবু’। সাধারণত তারা প্রতি বছর একটি করে উন্নতজাতের গরুর বাছুর কিনে আনেন। বছরখানেক লালন পালনের পর কোরবানির আগে সেটি বিক্রি করে দেন।
জেসমিন খাতুন বলেন, আগের দিন কোরবানির জন্য লালবাবুকে শহর থেকে লোকজন দেখতে আসে। তারা কেনার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে যান। বিষয়টি লালবাবু বুঝেছে। সে কারণে রাতভর সে কান্নাকাটি করেছে। তার দুই চোখ দিয়ে মানুষের মতো পানি পড়েছে।
কী বুঝেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ও বুঝেছে এখানে আর থাকতে পারবে না। অবলা প্রাণী, দীর্ঘদিন আমাদের আদর যত্নে ছিল; আপন ছিল। বাইরের লোকজনের আসা-যাওয়া, ছবি তোলা এসব দেখে বুঝেছে তাকে আর এখানে রাখা হবে না।
লালবাবু
সিন্ধি জাতের লালবাবুকে গত কোরবানির ঈদের চার দিন পর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কোলাবাজার থেকে ৯২ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন আব্দুল জলিল। প্রায় আড়াই বছর বয়সের এই লালবাবুকে মূলত দেখভাল করেন আব্দুল জলিলের স্ত্রী জেসমিন খাতুন ও তার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তন্বী খাতুন। ছোট মেয়ে ঐশী খাতুনও (৪) মাঝেমধ্যে এটা ওটা এনে খাওয়ায়।
যত্ন আত্তি
ঝাউদিয়া গ্রামে জলিল-জেসমিন দম্পতির চার শতক জায়গার ওপরে একতলা একটি বাড়ি। এখনও পলেস্তারা হয়নি। আব্দুল জলিল পরের জমিতে চাষ দেন। সামান্য কিছু জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন।
লালবাবুকে আনার পর ঘর লাগোয়া একটি টিনশেডের নিচে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। চারিদিকে খোলা এই জায়গায় সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচবার গোসল করানো হয়। গোসলের সময় তার দুইটি করে মিনিপ্যাক শ্যাম্পু লাগে।
খাবার দাবার
লালবাবু প্রতিদিন কাঁচা ঘাস, রান্না করা খুঁদ, বিছালী (খড়), ভুষি, ভুট্টা ও গম খায়। স্থানীয়ভাবেই এগুলো সংগ্রহ করা হতো। খাবারের জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০০ টাকা করে খরচ হয়েছিল।
গত এক বছরে লালবাবুর কোনও অসুখ হয়নি। সেকারণে কোনও ডাক্তারেরও প্রয়োজন পড়েনি বলে জানান জেসমিন।
চারিদিকে খোলা থাকায় এখানে পর্যাপ্ত বাতাস আসে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া তাই সবার চোখেই থাকতো। তার গায়ে একটা মাছি পড়ারও উপায় নেই।
জলিল-জেসমিন দম্পতি ৭-৮ বছর ধরে এভাবে গরু পোষেন। কোরবানির ঈদে এলে সেগুলো বিক্রি করে দেন।
মাঠে কাজ করার জন্য বাড়িতে ছিলেন না আব্দুল জলিল। জেসমিন খাতুন জানান, মেয়ে দুটোর মন খুব খারাপ। প্রিয় লালবাবুর অনুপস্থিতি তাদের পীড়া দিচ্ছে। বড় মেয়েটা লালবাবুকে গোসল করাতো। সেদিন রাতে কান্নার পর গরুটি তার নিয়মিত খাবার খেতে চাইছিল না। পরে মেয়েটি পাশের মাঠ থেকে কলাপাতা কেটে এনে খাইয়েছে। লালবাবু বিক্রির টাকা থেকে আবারও একটি অন্য জাতের গরু কেনার ইচ্ছে রয়েছে তাদের।
কদিন আগে বাড়িতে পোষা দুইটি ছাগল বিক্রি করেছেন ৩২ হাজার ৫০০ টাকায়। বাচ্চাসহ ৪০টি মুরগি রয়েছে তাদের। রান্নাঘরের পাশে লাউ গাছ, বেগুনের গাছও রয়েছে।
জেসমিন খাতুন বলেন, একটা সমিতিতে ২০ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে সেখানে ৫০০ টাকা কিস্তি দেই।
যশোর শহরে লালবাবু
১৬ জুন সকালে ঝাউদিয়া গ্রাম থেকে নছিমনে (স্থানীয়ভাবে নির্মিত যান) করে যশোর শহরের পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া এলাকায় মনিরুজ্জামানের বাড়িতে পৌঁছেছে লালবাবু। বরাবরের মতো এবারও কোরবানি দিচ্ছেন মনিরুজ্জামান দম্পতি। কোরবানিতে মনিরুজ্জামানের তিন ছেলে মাহমুদ উজ জামান, মাহবুব উজ জামান ও শফিক উজ জামান ছাড়াও রয়েছেন দুই শ্যালক যথাক্রমে ফসিয়ার রহমান ও আতিয়ার রহমান।
লালবাবু শহরের এই বাড়িতে পৌঁছানোর পর বেশ খুশি বাড়ির শিশু-কিশোররা। তারা গরুটিকে আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা ঘাস খেতে দিচ্ছে। কেউবা ছবি তুলছে।
এ বাড়ির বড় ছেলে ব্যাংকার মাহমুদ উজ জামান বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে আমরা কোরবানি দিয়ে আসছি। যখন থেকে আমরা বুঝেছি কোরবানি আমাদের ওপর ওয়াজিব এবং আল্লাহ তৌফিক দিয়েছে তখন থেকেই কোরবানি দিয়ে আসছি।
তিনি বলেন, যশোর সদরের ঝাউদিয়া গ্রামের আব্দুল জলিলের পোষা গরু লালবাবুকে প্রথম দেখেই পছন্দ হয়ে যায়। তারপর আমরা সেটি কিনে আনি।
কোরবানির জন্য প্রস্তুত
ঈদের দিন সকালে লালবাবুকে গোসল করিয়ে সাফসুতরো করা হয়। এরপর ঈদগাহে নামাজ আদায় করে বাড়ির লোকজন আরও কয়েকজনের সহায়তায় তাকে জবাই করার প্রস্তুতি নেন।
সাধারণত স্থানীয় মসজিদের ইমাম অথবা মুয়াজ্জিনকে দিয়ে কোরবানির পশু জবাই করানো হয়। তারপর কসাই দিয়ে মাংস প্রস্তুত করা হয়। শেষে ইসলামি হুকুমাত অনুসারে মাংস বণ্টন এবং নিজেদের জন্য রাখা হয়। তবে লালবাবুকে অন্য কাউকে দিয়ে নয়, মাহমুদ উজ জামান নিজেই গরুটি জবাই করেছেন।
এ বিষয়ে মাহমুদ উজ জামান বলেন, যিনি কোরবানি দেন, তিনি যদি পশু জবাই করেন তবে তা উত্তম। সাধারণত আমি নিজেই কোরবানি দিয়ে থাকি। এরপর মাংস সাত ভাগ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী মাংস বন্টণ করা হয়। দরিদ্র মানুষ, স্বজন- প্রত্যেককেই কিছু দিয়ে নিজেদের জন্য রাখি।
প্রচলিত অর্থে কোরবানি হলো- পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে কোনও ব্যক্তির পক্ষ থেকে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু জবাই করা। এটি হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য মাধ্যম।