বরিশালের ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীরা। বিশেষ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় নৌকার ভোটে বসিয়েছেন ভাগ। এছাড়া নিজেদের ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ের হাসি হাসার আশা করছেন তারা। আরেক আসনে নৌকার প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় অনেকটাই জয়ের পথে স্বতন্ত্র প্রার্থী।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির সেরনিয়াবাত সেকান্দার আলী (লাঙ্গল) এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. তুহিন (আম)। এর মধ্যে আবুল হাসানাতকে এগিয়ে রেখেছেন ভোটাররা।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে মহাজোটের প্রার্থী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নকুল কুমার বিশ্বাস (গামছা), জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির মো. শাহজাহান সিরাজ (সোনালী আঁশ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সাহেব আলী (আম), স্বতন্ত্র প্রার্থী একে ফাইয়াজুল হক (ঈগল) ও মো. মনিরুল ইসলাম (ঢেঁকি)।
এর মধ্যে বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য মনিরুল ইসলাম তিনবারের সংসদ সদস্য। পাশাপাশি ফাইয়াজুল হক হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতি। এখানে প্রকাশ্যে মেননের পক্ষে দুই উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ থাকার ঘোষণা দিলেও বড় একটি অংশ কাজ করছেন ফাইয়াজুলের পক্ষে। এছাড়া আগে যারা মনিরুলের নির্বাচন করেছেন তারা এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে নৌকার ভোট তিনভাগে বিভক্ত হলে জোটের প্রার্থী নির্বাচিত হতে বড় ধরনের বেগ পেতে হবে।
মনিরুল ইসলাম ও ফাইয়াজুল হক জানিয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এজন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা তাদের পক্ষে রয়েছেন। পাশাপাশি সঙ্গে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। ফলে জোটের প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে রাশেদ খান মেনন বলেছেন, জোট থেকে প্রার্থী হওয়ার পর বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্ধিত সভা করেছি। সভায় আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী নৌকাকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার করেছেন। আশা করছি, নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আমাকে বিজয়ী করবেন তারা।’
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতানের হাতুড়ির সঙ্গে লড়ছেন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু (লাঙ্গল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. আজমুল হাসান জিহাদ (ছড়ি), তৃণমূল বিএনপির শাহানাজ হোসেন (সোনালী আঁশ), স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আমিনুল হক (ঈগল) ও মো. আতিকুর রহমান (ট্রাক)।
এর মধ্যে আতিকুর রহমান বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য। গতবারের নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জোটের প্রার্থীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। বাবুগঞ্জ-মুলাদীতে রয়েছে তার শক্ত অবস্থান। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত উপজেলা পরিষদ এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ফলে জোটের প্রার্থীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি।
আতিকুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আসনটিতে জোটের প্রার্থী দেওয়ায় এলাকার কোনও উন্নয়ন হয়নি। নির্বাচিত হলে দুই উপজেলায় সমান উন্নয়ন করবো। একইসঙ্গে এলাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবো।’
তবে বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, ‘ভোটের মাঠে যতই অপপ্রচার থাকুক জয়ী হবো বলে আশা রাখছি। জোট থেকে মনোনয়ন দেওয়ায় নৌকার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আমার সঙ্গে আছেন।’
বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনে জাতীয় পার্টির মিজানুর রহমানের লাঙ্গলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের হৃদয় ইসলাম চুন্নু (ছড়ি) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ নাথ (ঈগল)। এখানে নৌকার প্রার্থী শাম্মী আহমেদ। দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মীর প্রার্থিতা গত ১৫ ডিসেম্বর বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এরপর প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন। সেখানেও বাতিল হওয়ায় হাইকোর্টে যান। প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার আবেদনের শুনানি ২ জানুয়ারি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে হবে। প্রার্থিতা ফিরে না পেলে আবারও এমপি হবেন পঙ্কজ নাথ।
বরিশাল-৫ (বরিশাল সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ ফারুকের নৌকার সঙ্গে লড়ছেন জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন (লাঙ্গল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আব্দুল হান্নান সিকদার (আম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. আসাদুজ্জামান (ছড়ি), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মাহাতাব হোসেন (ডাব) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সালাহউদ্দিন রিপন (ট্রাক)।
এখানের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর মনোনয়ন দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে বাতিল হওয়ায় রিপনের পালে হাওয়া লেগেছে। নগরীতে প্রচার রয়েছে আগামী ২ জানুয়ারির সর্বশেষ শুনানিতে সাদিকের মনোনয়ন বাতিল হলে সেক্ষেত্রে রিপনকে তিনি সমর্থন দেবেন। সেই সমর্থন রিপন পেলে নৌকার প্রার্থীকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। তাতে করে নৌকার জয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। কারণ নৌকার প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীমকে এলাকাবাসী সৎ হিসেবে চেনেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহউদ্দিন রিপন বলেন, ‘গেলো সাতটি বছর বরিশাল সদর আসনে কাজ করেছি। বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এলাকাবাসীর কাছে থাকার চেষ্টা করেছি। আশা করছি, ভোটাররা বিমুখ করবে না।’
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাফিজ মল্লিকের নৌকার সঙ্গে লড়ছেন জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির টি.এম. জহিরুল হক (সোনালী আঁশ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. মোশারফ হোসেন (আম), জাসদের মোহাম্মদ মোহসীন (মশাল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. মাইনুল ইসলাম (ডাব), স্বতন্ত্র মো. শাহবাজ মিঞা (ঈগল), মো. কামরুল ইসলাম খান (তরমুজ), মো. জাকির খান সাগর (রকেট) ও মোহাম্মদ শামসুল আলম (ট্রাক)।
এই আসনে নৌকা না পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম। প্রার্থী হয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নৌকার প্রার্থীর চেয়ে পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবেন। পরপর তিনবার চেয়ারম্যান এবং দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে রয়েছে তার সম্পৃক্ততা। একইভাবে সম্পর্ক তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে। সেইসঙ্গে নিজের ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিজয়ের হাসি হাসতে চান। এই আসনে নৌকার প্রার্থী হাফিজ মল্লিক। তবে তার সঙ্গে এলাকাবাসীর তেমন সম্পৃক্ততা না থাকার বিষয়টি জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে নাসরিন জাহান ভোটে ভাগ বসাতে চান। ফলে নৌকার প্রার্থীকে জয় পেতে বেগ পেতে হবে।
তবে এসব বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না হাফিজ মল্লিক। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কৌশল হিসেবে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। যা ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে না। এখানে দীর্ঘদিন পর নৌকার প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নের স্বার্থে এলাকাবাসী আমাকে নির্বাচিত করবেন।’