ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর গ্রামে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন
বাংলাদেশ

ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর গ্রামে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরিঘাটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক কয়েকজনের প্রশ্ন, ‘সাংবাদিক ভাই, মতিউরের (মতিউর রহমান) বাড়িতে যাবেন? ওই বেডা ওতো টাকা কীভাবে কামাইলো? ভাই ভালো করিয়া লেইখেন। এরা যেন কোনোভাবেই ফসকাইয়া যাইতে না পারে। ওনারে (মতিউর) কেউ চিনতো না। পোলার ছাগলকাণ্ডের পর সে তো আমাদের এলাকার বিখ্যাত লোক হয়ে গেছে। তার বাড়ি যে মুলাদীতে তাও জানতাম না। মিডিয়ার বদৌলতে আমাগো মুলাদীর নামটা সারা বিশ্বে ছড়াইয়া গেছে। তবে ভালো কাজে নামটা ছড়াইলে ভালো লাগতো।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান পিন্টু মুলাদী উপজেলার কাজীর চর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের হাকিম হাওলাদারের ছেলে। বিএনপি নেতা হাকিম হাওলাদার কাজীরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি ছিলেন। এর আগে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন হাকিম হাওলাদার। জনশ্রুতি রয়েছে ছেলে মতিউরের টাকায় তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে নয় বছর দায়িত্ব পালন করেন।

মতিউর তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার বড়। দুর্দান্ত মেধাবী ছিলেন মতিউর। তিনি বাবুগঞ্জে খালার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন।

কাজীরচর ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তার (হাকিম হাওলাদার) ছেলে কী করেছে সেটা আমার জানার বিষয় নয়। তবে তার বাবা হাকিম হাওলাদার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ কারণে তাকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার মেজ ছেলে কাইয়ুম হাওলাদার ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তবে হাকিম হাওলাদার খুব ভালো মানুষ ছিলেন। এ কারণেই গ্রামবাসী ভোট দিয়ে তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনোদিন সামান্যতম অভিযোগ উত্থাপন করেননি।’

তিনি আরও জানান, মতিউর বড় কর্মকর্তা ছিলেন এর বেশি কিছু তার জানা নেই। এখন বিভিন্ন মিডিয়ায় তার বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারির খবর দেখছেন এবং শুনছেন এ পর্যন্তই।

মতিউরের বাড়ির সকলেই যেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তারা তাদের নিজেদের পরিচয়টা পর্যন্ত দিতে চাচ্ছেন না। সাংবাদিক দেখলেই যে যার মত করে চলে যাচ্ছেন। দাঁড়াতে বললে আমি কিছু জানি না বলে সটকে পড়ছেন। একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দাদেরও।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে মতিউরের নিকট আত্মীয় এবং একাধিক গ্রামবাসী জানিয়েছেন, মতিউরের টাকার পাখা গজানো শুরু হয় বিএনপি আমলে। এরপর থেকে ওই পরিবারকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মতিউরের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্য খুলতে শুরু করে তার গ্রামের বাড়ির লোকজনেরও। সেখানে তিনি মাদ্রাসা এবং নিজের থাকার জন্য গড়ে তোলেন দ্বিতল ভবন।

বাড়িতেই প্রবেশ করতেই বড় পুকুর। যার ঘাট বাঁধাই করা। এরপর তিনতলা মাদ্রাসা এবং মসজিদ, যা মতিউরের বাবার নামে গড়ে তোলা হয়েছে। মাদ্রাসা এবং মসজিদের মাঝ বরাবর নির্মিত হয়েছে একটি বড় মিনার। সেই মিনার নিচ থেকে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে দ্বিতল ভবনের। মাঝেমধ্যে মতিউর গ্রামের বাড়িতে আসলে ওই ভবনে রাত কাটাতেন। এ ছাড়া ভিআইপি মেহমান আসলেই কলাপসিবল গেটের তালা খোলা হয়। এ ছাড়া বছরের বেশির ভাগ সময় ভবনটি তালাবদ্ধ থাকে বলে জানান মাদ্রাসার শিক্ষকেরা।

এখানেই শেষ না, এলাকায় বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গড়ে তোলেন হাওলাদার ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এলাকায় রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ এবং তিনতলা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেন। গড়ে তোলা হয় মসজিদ, মাদ্রাসা, ক্লিনিক। এ ছাড়া ছোট ছোট ব্রিজ, সড়ক এবং খালপাড় বাঁধাই করা হয়। হাওলাদার ফাউন্ডেশনের নামে এসব উন্নয়নে দেখানো হলেও বরাদ্দ আনা হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ (পাউবো) বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে।

মতিউরের ছোট ভাই কাইয়ুম হাওলাদার বাড়ির সবকিছু দেখভাল করেন। ঢাকায় কাইয়ুমেরও রয়েছে বিশাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। মুলাদী সদরে বিশাল ভবন কিনেছেন। কাইয়ুম এতসব কিছুর মালিক হয়েছেন তার ভাইয়ের বদৌলতে। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ আটকে যান নাম প্রকাশ না করা ওই ব্যক্তি।

প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় কী হয়েছে না হয়েছে তা মিডিয়ার মাধ্যমে শুনছি। তবে গ্রামবাসী ধারণা, এসব কিছু মতিউর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কারণ তাদের বিরুদ্ধে গ্রামে কোনও বদনাম নেই।’

গ্রামবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে, গ্রামে একরের পর একর জমি রয়েছে মতিউরের। তবে তার বেশির ভাগ ভাইবোন এবং আত্মীয়স্বজনের নামে। তার নামে যা রয়েছে তা খুবই সামান্য। তবে গ্রামবাসী হাকিম হাওলাদারের মতো মতিউরকেও ভালো মানুষ হিসেবেই জানতেন। তার বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের পর তারা নিশ্চিত হন কীভাবে পাহাড়সমান টাকার মালিক হয়েছেন মতিউর। এতে করে মতিউরের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা আসলেও তা প্রকাশ করছেন না।

কাজিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস বলেন, ‘হাকিম হাওলাদারের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেন মঙ্গুর ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের রেশ ধরেই বিএনপির আমলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন হাকিম হাওলাদার।’ এ ছাড়া মতিউরের বিষয়ে তিনি তেমন কিছু জানেন না। তবে মতিউরের টাকায় চলতো তার গ্রামের বাড়ির লোকজন। আর তার টাকায় বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়। যার বেশির ভাগই বিতর্কিত ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

Source link

Related posts

বেপরোয়া গতি, ১৭ মাসে ঝরেছে ১৬২ প্রাণ

News Desk

চসিকের স্বাস্থ্য খাতের লুপ্ত সুনাম পুনঃরুদ্ধার করা হবে

News Desk

‘উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করুক’

News Desk

Leave a Comment