ছেলের এভারেস্টজয়ে বাবার মুখে হাসি, মা বললেন দুশ্চিন্তায় আছি
বাংলাদেশ

ছেলের এভারেস্টজয়ে বাবার মুখে হাসি, মা বললেন দুশ্চিন্তায় আছি

এভারেস্টজয়ী বাবর আলীর বাড়িতে চলছে উৎসব। রবিবার (১৯ মে) সকাল থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়াহাট এলাকার বাদশা মিয়া সিপাহি বাড়ির মো. লিয়াকত আলীর ঘরে এই উৎসব চলছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বাবরের বন্ধুরা ছুটে আসছেন। ভিড় করেছেন সংবাদকর্মীরাও।

বেলা ১১টার দিকে তাদের বাড়ির সামনে যেতেই মানুষের ভিড় চোখে পড়ে। কয়েকজন প্রতিবেশী বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের কাছে খোঁজ জানতে চাইলে নিয়ে যান। বাসায় ঢুকতেই স্বজনদের দেখা গেলো। এগিয়ে এলেন বাবরের বাবা মো. লিয়াকত আলী। পরিচয় দিয়ে কথাবার্তা বলার একপর্যায়ে স্ত্রী লুৎফুল নাহার বেগমকে ডেকে আনেন। জানালেন তাদের আনন্দ ও দুশ্চিন্তার কথা। শোনালেন ছেলের সফলতার গল্প।

বাড়ির দেয়ালে নানা পদক

বাবরদের বাড়িটি দোতলা। এর একটি কক্ষে থাকেন বাবর। তার কক্ষে যেতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগে চোখ আটকে গেলো দেয়ালে। পর্বতারোহণের ছবি ও অর্ধশতাধিক পদক ঝুলছে দেয়ালজুড়ে। কলকাতা পুলিশ সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ হাফ ম্যারাথনের, কাপ্তাই হাফ ম্যারাথন, সাইক্লিং ম্যারাথন জয়ের পদকগুলো দেখা গেলো সিঁড়ির দেয়ালে। দোতলায় বসার ঘরে আরও কিছু পদক ও সম্মাননা রাখা ছিল। এসব দেখে কারও মনে হবে না, এভারেস্টজয়ী বাবর পেশায় চিকিৎসক।

বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে বাবর দ্বিতীয়। বাড়িটিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল ছেলেটি পেশায় চিকিৎসক। ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। পেয়েছেন অসংখ্য পদক ও পুরস্কার। সেগুলো সাজানো আছে পুরো বাড়িতে। এর মধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পদক আছে।

এই দম্পতির ছেলে বাবর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। রবিবার নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় চূড়ায় পৌঁছান। বাবরের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীর দোয়ায় প্রকৃতিমাতা (এভারেস্ট) বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এখন বাবর আছে ক্যাম্প ৪-এ নামার পথে। ওই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই অভিযানের ছবি পেতে সময় লাগবে।’

সকালেই ছেলের এভারেস্টের চূড়া স্পর্শ করার খবর পেয়েছেন মা-বাবা। এরপর থেকেই তাদের কাছে অনবরত ফোন আসছে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী অনেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। বাড়িতে আসছেন অনেকে।

বাবরের শোয়ার ঘরের সাজানো চিত্র দেখালেন মা

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বাসায় গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই লিয়াকত আলী এগিয়ে এসে বলতে শুরু করলেন, ‘সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত। সবাই ফোন করছে, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা আসছে। খোঁজখবর নিচ্ছে বাবরের। তার বন্ধুরাও আসছে। তাদের সবাইকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে। সবমিলে ভালো লাগছে।’ 

কথাগুলো বলতে বলতে পাশের সোফায় বসলেন। এরপর পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি কুয়েতপ্রবাসী ছিলাম। ২০১৭ সালে দেশে ফেরার পর আর যাইনি। এখন বাড়িতেই থাকি। আমার তিন ছেলে এক মেয়ে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বাবর। বড় ছেলে মামুন আলী ব্যারিস্টার। পরিবার নিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। দ্বিতীয় ছেলে বাবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছে। মেয়ে হামিমুন তানজিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কক্সবাজার আদালতে কর্মরত। ছোট ছেলে মো. আবির আলী বিকাশের কর্মকর্তা হিসেবে আছে।’

ছেলের শৈশবের স্মৃতি জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল। স্কুল জীবনে প্রতিটি খেলাধুলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছে। সৃজনী গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল। এ কারণে স্বপ্ন ছিল ডাক্তারি পড়াবো। এমবিবিএস পড়ে সে স্বপ্নপূরণও করেছে। তবে তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হবে। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি ৬৪ জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেছিল। কাশ্মীরে সাইকেল যাত্রায় অংশ নিয়েছিল। লিখেছে ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে বইও।’

পর্বত আরোহণের যাত্রা

পর্বত আরোহণের যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছিল জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, ‘ট্রেকিং জগতে হাতেখড়ি ২০১০ সালে। ওই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়ায়।। সফলতার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বান্দরবানের একাধিক পাহাড়ে উঠেছিল। এরপর কীভাবে বিশ্বের বড় বড় পর্বতে উঠবে, সেই পরিকল্পনা চলতে থাকে। পরে নেপালের পাহাড়ে ওঠে। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম (২২ হাজার ৩৪৯ ফুট) আরোহণ করে। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভাবনা শুরু হয়। এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। এই কথা শোনার পর দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই আমরা। নিষেধ করেছিলাম। কারণ চূড়ায় উঠতে গিয়ে অনেকের মৃত্যুর কথা আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। নিষেধ করার পর থেকে আমাদের কিছু জানাতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে যাত্রার দিন বলেছিল। সর্বশেষ ১৫ মে শেষবার কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনও কথা হয়নি। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হয়েছে। বাবা হিসেবে গর্ববোধ করছি।’

বাবরের ঘরের দেয়ালে ঝুলছে নানা ইভেন্টে অংশগ্রহণের পদক

যেভাবে রচিত হলো ইতিহাস

গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশে রওনা দেন বাবর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেসক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল। ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। এজন্য একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করেছেন। ২৬ এপ্রিল বেসক্যাম্প থেকে এভারেস্টের ক্যাম্প–২ পর্যন্ত ঘুরে এসে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব সমাপ্ত করেন। এরপর অনুকূল আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। ১৪ মে মাঝরাতে বেসক্যাম্প থেকে চূড়া অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। সেখানে দুই রাত কাটিয়ে উঠে যান ক্যাম্প ৩-এ। সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ‘ডেথ জোন’। ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় যাত্রা। ১৯ মে ভোরে ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা। 

দুশ্চিন্তা কাটেনি মায়ের

বাবরের এই যাত্রায় এখনও দুশ্চিন্তা কাটেনি মায়ের। লুৎফুল নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার দুশ্চিন্তা এখনও কাটেনি। প্রথমে দুশ্চিন্তা ছিল ঠিকমতো চূড়ায় উঠতে পারবে কিনা, তা কেটে গেছে। তবে এখনও সুস্থভাবে নেমে আসতে পারবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। সে নেমে না আসা পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা দূর হবে না। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে।’

এভারেস্টজয় তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু আমাদের চাওয়া এটা ছিল না উল্লেখ করে লুৎফুল নাহার বলেন, ‘কারণ এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন ও যাত্রা। আমার প্রত্যাশা ছিল, ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হয়ে ভালোভাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। সে চিকিসা পেশায় থাকুক, এটাই আমার চাওয়া।’

বাবরের পদকগুলো দেখাচ্ছেন মা লুৎফুল নাহার

বাবরের লেখা বই ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’

বাবরের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা’। বইটির পরিচিতিতে লেখা হয়, পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি। এই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জন্ম, বেড়ে উঠা ও শিক্ষাজীবন চট্টগ্রামে। এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে কাজ করছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবিতে।

বইতে লিখেছেন, ২০১৯ সালে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন ৬৪ জেলা। এতে সময় লেগেছে ৬৪ দিন। দেশ দেখা আর মানুষের সঙ্গে ভাব-বিনিময় ছাড়াও পদযাত্রাকালীন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য গণসচেতনতা তৈরি করেছেন। তাদের জানিয়েছেন পরিবেশগত ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামুদ্রিক প্রাণের ঝুঁকির তথ্য।

বাবরের প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্নবাজ। পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা, সাইকেল চালিয়ে দেশ ভ্রমণসহ নানা স্বপ্নপূরণ করেছেন। চিকিৎসক হওয়ায় এলাকায় সুনাম আছে।’

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৪ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারস্টজয় করেন এম এ মুহিত। ২০১২ সালের ১৯ মে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্টজয় করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে এভারেস্টজয় করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১৩ সালের ২০ মে পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে খালেদ হোসাইন। তিনি এভারেস্ট চূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান। ১১ বছর পর আরেক বাংলাদেশি পতাকা ওড়ালেন এভারেস্টের চূড়ায়।

Source link

Related posts

নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা অব্যাহত রাখতে ব্যবস্থা নিয়েছি: প্রধানমন্ত্রী

News Desk

আ.লীগের ৪ নেতাকে অব্যাহতি

News Desk

স্যালাইন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে অপসো-ওরিয়ন-লিবরা ও পপুলার, দাম দ্বিগুণ

News Desk

Leave a Comment