ছেলের রক্তে ভেজা লাশ দেখে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন বাবা আব্দুল কুদ্দুস হাওলাদার। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ। হাসপাতালের বারান্দায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তার কান্নায় সবার চোখে পানি ছলছল করছিল। একপর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।
রবিবার (২৯ মে) ভোর ৫টায় বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার শানুয়ার এলাকায় গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় ১০ যাত্রী নিহত হন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বরগুনা সদর উপজেলার কেওরাবুনিয়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস হাওলাদারের ছেলে ইমরান আহমেদ (২৬)। বিকালে হাসপাতাল থেকে ছেলের লাশ নিতে এসে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আব্দুল কুদ্দুস। তার মতো বাকরুদ্ধ হয়েছেন নিহত আরও সাত জনের স্বজনরা।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে স্বজনদের এমন আহাজারি দেখা গেছে। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল আশপাশের পরিবেশ। স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ।
আরও পড়ুন: গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় নিহত ১০
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ইমরান আহমেদ বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে রবিবার রাতে সাভারের নবীনগর থেকে রওনা হন। ভোর ৫টায় বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার শানুয়ার এলাকায় গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় তিনি নিহত হন। তার সঙ্গে নিহত হন আরও নয় জন। একই ঘটনায় আহত হন আরও ২০ জন। আহত ও নিহতদের লাশ উদ্ধার করে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
খবর পেয়ে দুপুরে লাশ নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন ইমরানের বাবা। এসে দেখেন ছেলের এক হাত বিচ্ছিন্ন। শরীরটা রক্তে ভেজা। চোখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।
পুলিশ ও বাসযাত্রীরা জানিয়েছেন, যমুনা লাইন পরিবহনের বাসটি ঢাকা থেকে ভান্ডারিয়ায় যাচ্ছিল। শানুয়ার এলাকায় পৌঁছালে মেহগনি গাছের সঙ্গে ধাক্কায় বাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। বাসচালক ঘুমিয়ে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উজিরপুর মডেল থানার ওসি আর্শেদ আলী বলেন, ‘রবিবার বিকালে ১০ জন নিহতের ঘটনায় বাসচালককে অভিযুক্ত করে মামলা করেছেন পুলিশের সার্জেন্ট মাহাবুবুর রহমান। তবে চালকের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে এবং তাকে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক টিম অভিযান চালাচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ১০ জন নিহত: বাসে ডাকাত বলে চালকের পলায়ন
ওসি আরও বলেন, ‘বিকালে আট জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের কোনও অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত দেওয়ার পর লাশ হস্তান্তর করা হয়। তবে এখনও দুই জনের লাশ নিতে আসেননি স্বজনরা। এরমধ্যে একজনের পরিচয় মিলেছে। অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। দুটি লাশ শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে।’
শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারতলায় চিকিৎসাধীন বাসের আহত যাত্রী সেলিম ও কালু জানান, তারা বাসের পেছনে বসেছিলেন। বাসটি যখন গাছে ধাক্কা দেয় তখন যাত্রীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। গাছে ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব যাত্রী কমবেশি আহত ও নিহত হন। ওই সময় চালক ঘুমিয়ে ছিলেন। পরে বাসে ডাকাত ঢুকেছে বলে চালক পালিয়ে যান।
আরও পড়ুন: ১০ জন নিহত হওয়া বাসের চালক ঘুমাচ্ছিলেন
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাশ নিতে আসা স্বজনরা জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত এভাবে দুর্ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হয়। কিন্তু চালকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তাদের কোনও বিচার হয় না। এ ঘটনায় জড়িত বাসচালক ও হেলপারের কঠোর শাস্তি চান স্বজনরা।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রকিবুর রহমান খান। অন্য সদস্যরা হলেন—বিআরটিএ উপ-পরিচালক ও উজিরপুর থানার ওসি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করবে। নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’