Image default
বাংলাদেশ

জনপ্রিয়তা বাড়ছে পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোর

কুমড়ো ফুলের বড়া, সোনামুগ ডাল, কুমড়োর ছক্কা, আমকই, জলপাইয়ের চাটনি—কল্লোল লাহিড়ীর ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ উপন্যাস যারা পড়েছেন তাদের কাছে খাবারের এই পদগুলো চেনা এবং এর স্বাদ নেওয়ার বাসনাও নিশ্চয় সব পাঠকের হয়েছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র ইন্দুবালার রান্না করা বিশেষ পদগুলো না হলেও অন্তত বেশিরভাগ হোটেল থেকে একটু ভিন্ন ও ঘরোয়া স্বাদ নিতে চাইলে যেতে পারেন পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের নিরামিষ হোটেলগুলোতে।

বিরিয়ানির জন্য সুখ্যাত পুরান ঢাকায় নিরামিষ খাবার দোকানের কথা শুনে হয়তো একটু অবাক হচ্ছেন। কিন্তু কাবাব-কাচ্চি-লাচ্ছি-বাকরখানির ভিড়ে এই দোকানগুলোর কাশ্মীরি পনির, ছানার ধোকা, সয়াবিন সবজি, পটল-সরিষা ভুনা, ডালের বড়ার রসার স্বাদ খাদ্যরসিক মানুষদের জন্য ভিন্ন এক আকর্ষণ।

তাঁতিবাজার শিবমন্দিরের পৌঁছে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল, জগন্নাথ ভোজনালয়, আদি গোবিন্দ হোটেল, জয় মা তারা ভোজনালয়, রাধামাধব নিরামিষ ভোজনালয় আর গোপীনাথ নিরামিষ ভোজনালয়। খাবারের পদের সংখ্যায় পার্থক্য থাকলেও মান সবার কাছাকাছিই। সাধারণ সাজসজ্জার হলেও প্রতিটি হোটেলই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হোটেলগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে।

জনপ্রিয়তা বাড়ছে পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোর

যেসব খাবার পাবেন

যেকোনও একটি হোটেলে গিয়ে বসলেই আপনার সামনে চলে আসবে স্টিলের থালায় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। তারপর ট্রেতে সাজানো ছোট ছোট বাটিতে ১২-১৪ পদের নিরামিষ তরকারি। এসবের মধ্যে পাবেন কাঁচা কলার রসা, মটর ডাল, সাগুদানা ভুনা, পাঁচ তরকারি, লাউ তরকারি, ছানার রসা, কাশ্মীরি পনির, আলু-পটলের রসা, মুগ ডাল, বুটের ডাল, বিভিন্ন ধরনের শাকভর্তা, ছানার ধোকা, সয়াবিন সবজি, কলার মোচার তরকারি, পটল-সরিষা ভুনা, ডালের বড়ার রসা আর মৌসুমি সবজির তরকারি। আর শেষ পাতে পাবেন চাটনি ও আলু-গাজরের পায়েস।

এছাড়াও জগন্নাথ ভোজনালয়ে ৮-১০ রকমের ভর্তা পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে আছে বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা, শিম ভর্তা, সরিষা ভর্তা, কচুর লতি ভর্তা ইত্যাদি।

তবে এসব হোটেলে একাদশীর (চান্দ্র তিথি) দিনে খাবার তালিকায় থাকে বৈচিত্র্য। এদিন শুধু পুষ্পান্ন (পোলাও), খিচুড়ি, ছানার রসা, বাদাম ভুনা, ফুলকপির রসা, সাগুদানা ভুনা, পাঁচ তরকারি ও শ্যামা দানার পায়েসের আয়োজন করা হয়। এই দিনের পদগুলোর সঙ্গে অন্যদিনের পদগুলোর পার্থক্য হচ্ছে মূলত মসলা ও তেলের ব্যবহারে। মসলা হিসেবে শুধু আদা ও কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয়। আর সয়াবিন তেলের বদলে ব্যবহার করা হয় সূর্যমুখীর তেল। তবে বাকি দিনগুলোতে সয়াবিন তেল ও সাধারণ মসলাদি দিয়েই রান্না করা হয়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার হয় না এসব রান্নাতে।

পার্শ্ববর্তী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্ধুদের সাথে জগন্নাথ ভোজনালয়ে নিরামিষের স্বাদ নিতে এসেছিলেন রাসেল পারভেজ রনি। বলেন, ‘ফেসবুকে দেখে ব্যতিক্রম স্বাদ নিতে বন্ধুদের নিয়ে খেতে এসেছি। সাধারণ হোটেলগুলোতে গুরুপাক রান্না থাকে, কিন্তু এখানে ঠিক উল্টো—সব নিরামিষ। খাবার মান যথেষ্ট ভালো। অধিকাংশ রান্নাই আগে কখনও খাওয়ার সুযোগ হয়নি, তাই ভিন্ন স্বাদ নিতে ভালোই লাগছে।’

কেমন খরচ পড়বে

খাবারের এসব পদের প্রতিটির দাম ১০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। প্রতি বাটি ভর্তা ১০ টাকা, ছোট বাটি তরকারি অথবা ভাজি ২০ টাকা এবং বড় বাটিতে তরকারি ৩০-৪০ টাকা। ভাত প্রথমবার ১৫ টাকা, পরে যতবার নিবেন ৫ টাকা প্লেট। মোটামুটি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় কবজি ডুবিয়ে খেতে পারবেন হোটেলগুলোতে।

জনপ্রিয়তা বাড়ছে পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোর

সবচেয়ে পুরনো বিষ্ণুপ্রিয়া, জনপ্রিয় জগন্নাথ ভোজনালয়

পুরান ঢাকার বিরিয়ানির ভিড়ে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে সগৌরবে টিকে থাকা হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল। হোটেলটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সুমন হালদার জানান, ২০০০ সালের দিকে যাত্রা শুরু করা হোটেলটি বর্তমানে এখনও সমানতালে গ্রাহকদের উদরপূর্তি করে আসছে। কয়েকবার হাতবদল হওয়ার পর ২০১৭ সাল থেকে সরস্বতী হালদার মালিকানায় রয়েছেন। করোনার পর হোটেলের নাম পরিবর্তন করে হরে কৃষ্ণ ভোজনালয় রাখা হলেও লোকমুখে এটি বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল নামেই পরিচিত। ভাই ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজেই রান্নাঘর আর পরিবেশনার কাজ সামলান সরস্বতী হালদার।

২০০৫ সালে নিতাই পালের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় জগন্নাথ ভোজনালয়ের। রান্নার পদের সংখ্যায় অন্যান্য হোটেলের থেকে বেশি হওয়ায় শুরুতেই জনপ্রিয়তা পায় হোটেলটি। রান্নার মান ও খদ্দেরদের সেবার মান এখনও ধরে রেখেছে হোটেলটি। হোটেলটিতে একসঙ্গে বসতে পারেন ৩৬ জন। করোনায় নিতাই পালের মৃত্যুর পর হোটেলের মালিকানা বদলায়। বর্তমানে এটির তত্ত্বাবধানে আছেন অশোক কবিরাজ।

বরিশাল থেকে ৭ বছর আগে ঢাকা আসেন দীপু বিশ্বাস। তখন থেকে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন জগন্নাথ ভোজনালয়ে। তিনি বলেন, ‘তাঁতিবাজারসহ আশপাশের এলাকার দোকানিরা আমাদের এখানের নিয়মিত খদ্দের। সারা দিন খদ্দেরের আনাগোনা থাকলেও দুপুরে প্রচুর ভিড় হয়, খদ্দেররা চেয়ার ফাঁকা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন, আমাদের সামলাতে বেগ পেতে হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই খদ্দের আসে।

জনপ্রিয়তা বাড়ছে পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোর

পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের বাসিন্দা সঞ্জীব ঘোষ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০০০ সালের পর পর নিরামিষ দোকানগুলো শুরু হয়। তাঁতিবাজার শিবমন্দির এলাকায় প্রথম বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেল শুরু হয়। তখন থেকেই আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিরামিষের দিন এই হোটেলগুলোতে খাওয়া-দাওয়া করি। নিরামিষ দিন ছাড়াও বাসায় কোনও কারণে রান্না না হলে এই হোটেলগুলোতে আসি।’

স্বাদ ও স্বাস্থ্য সচেতনতার মেলবন্ধন

পুরান ঢাকার এসব হোটেলের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু ব্যতিক্রমী খাবার বলে নয়, স্বাস্থ্য সচেতন সব বয়সী মানুষই এসব হোটেলে নিয়মিত খাচ্ছেন। পুরান ঢাকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, পার্শ্ববর্তী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য কলেজ-স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই হোটেলগুলোর নিয়মিত খদ্দের। এছাড়াও বন্ধুর মুখে শুনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিরামিষ খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন খাদ্য রসিকরা। নিরামিষ দোকান বলে শুধু হিন্দুরা খদ্দের এমন না—প্রতিদিনই অনেক মুসলমান ও অন্য ধর্মের মানুষ নিয়মিত খেতে আসেন এসব হোটেলে।

জগন্নাথ ভোজনালয়ের মালিক শিল্পী রানী বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনের রান্নার জন্য প্রতিদিন জোগাড় করি। আগের দিনের কিছু ব্যবহার করা হয় না। টাটকা জিনিস দিয়ে সব রান্না হয়। পেঁয়াজ বা রসুন ব্যবহার করা হয় না। তবে চেষ্টা করা হয় যত্ন করে রাঁধার, যাতে বাড়ির রান্না মনে হয় খদ্দেরদের। কর্মচারীদেরও বলা আছে পরিবেশনে যাতে ত্রুটি না হয়, মানুষ যেন রান্না-পরিবেশন দুটোই ভালো মনে করে খাবার খায়।

জনপ্রিয়তা বাড়ছে পুরান ঢাকার নিরামিষ হোটেলগুলোর

Related posts

দেশজুড়ে শনাক্ত ১০ লাখ ছাড়াল

News Desk

অবিশ্বাস্য! শামির ৪ বলে ৪ উইকেট হারাল অস্ট্রেলিয়া (ভিডিও)

News Desk

মুজিবনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ জন, আহত ২

News Desk

Leave a Comment