Image default
বাংলাদেশ

জামালপুরের নকশীকাঁথা ও বাহারী পোশাক সারা দেশে প্রশংসিত

প্রাচীন ব্রক্ষ্মপুত্র ও যমুনা নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্গত জেলা জামালপুর যার নাম শুনলেই মনে পড়ে প্রাচীন ঐতিহ্যময় কারুশিল্প ও হস্তশিল্পের কথা। তাই জামালপুর জেলাকে অনেকেই বলে থাকে ‘হস্তশিল্পের শহর’ আর ‘নকশি কাঁথা’ জামালপুর জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে পরিচিত।

হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে জামালপুর জেলা সারা বিশ্বে সমাদৃত। এ অঞ্চলের কারুশিল্পের ও হস্তশিল্পের চমৎকার নিদর্শনসমূহের মাঝে নকশি কাঁথা, মৃৎ শিল্প, কাঁসাশিল্প, নকশি পাখা, নকশি শিকা, বাঁশের তৈরি চাটাই, ধারাই, খাঁচা, কোলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হারিয়ে যেতে থাকা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য- হস্তশিল্প বর্তমান জামালপুর জেলার হাজারো মানুষের একমাত্র অবলম্বন।

jamalpur
ছবি: jaijaidinbd.com

কৃষিপ্রধান জামালপুর জেলাতে প্রতি বছর নদী ভাঙ্গন ও বন্যায় অনেক মানুষের জমি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায় যা সাধারণ মানুষদের হতাশাগ্রস্থ করে তুলে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে কিন্তু আশির দশকে জামালপুর জেলায় হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে সাধারণ মানুষ নিদারুণ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি লাভ করে, তাদের আয়-রোজগারের বিকল্প উৎস সৃষ্টি হয়।

গৃহস্থের সকল কাজের পাশাপাশি অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করা সহজ বলে ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ নারীরাও এ কাজ করে নিজেদের সাবলম্ভী করে তুলতে পারে; আয় বাড়ে সাথে কর্মসংস্থানও বাড়ে, বেকারত্ব লাগব হয় ও হতাশা হ্রাস পায়, মানুষ কর্মমুখী হয়, প্রকৃত জীবনমুখী হয়। বর্তমান সময়ের প্রায় ৬০-৭০ভাগ পরিবারের সন্তানরাই নিজেদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে নিপুণভাবে হস্তশিল্পের কাজ করে থাকে।

jamalpur 2
ছবি: dainikpanchagarh.com

জামালপুর জেলায় এ কারুশিল্প বা হস্তশিল্পের প্রসার একদিনেই হয় নি। আধুনিক চাকচিক্যময় অবস্থানে হারিয়ে যেতে বসা হস্তশিল্পের ঐতিহ্যময় ইতিহাস অনেক প্রাচীন। গ্রাম-বাংলার মহিলারা একসাথে বসে নানা আলাপ-আলোচনা, গল্প-কথার মিলনে শেষ করত প্রতিটি কাজ। আর সেই সকল সূচিঁকর্মের সাথে মিশে থাকত তাদের অনেক ভালোবাসা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, বিরহ-বেদনা। পল্লীকবি জসীমদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ নামক অমর আখ্যানের মতো আবহমান বাংলার নারীরা প্রতীক্ষার প্রহর কাটতে নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আচড় দিয়ে যায়, কাঁথায় লেখে কত সুখ-দুঃখ গাঁথা। প্রবাসে কিংবা বিদেশ বিভূঁইয়ে আত্মীয় স্বজন কিংবা পরিবার পরিজনের স্মৃতি কাঁথার জমিনে জীবন্ত হয়ে ওঠে আর তাইতো এতো সুন্দর হয় এই নকশি কাঁথা।

৭০দশকের শেষভাগে বিলুপ্তপ্রায় হস্তশিল্পকে ৮০দশকের শুরুতেই পুনরুদ্ধার করে বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় গতিযোগ করে ব্র্যাকের সহযোগী ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ নামক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাক জামালপুরের বিভিন্ন গ্রামের সূচী শিল্পীদের খুঁজে বের করে নকশী কাঁথা শিল্পের নবউত্থান ঘটায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় । পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে বেসরকারী সংস্থা উন্নয়ন সংঘ একহাজার গ্রামীণ মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশী কাঁথার কার্যক্রম শুরু করে।

jamalpur 3
ছবি: jagonews24.com

জামালপুর জেলার সকল উপজেলাতেই নকশী কাঁথা শিল্পের উৎপাদন হয় এবং প্রায় ৩০০ এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নকশী কাঁথা শিল্পের জিনিস পত্রাদির মধ্যে রয়েছে নকশী কাঁথা, বেড কভার, থ্রীপিছ, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ী, পাঞ্জাবী, টি শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিজ পাঞ্জাবী, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ীর পাইর, শাল চাদর ইত্যাদি।

জামালপুরের নকশী পণ্যের কদর বাড়ছে দেশে-বিদেশে। জামালপুর জেলা শহরেও রয়েছে এ শিল্পের ছোট-বড় অনেক শো-রুম। কিন্তু বিপনন সমস্যা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর পুঁজির অভাবে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার নারী-কর্মীরা। ইচ্ছে মতো মালিকের দেয়া অল্প মজুরীতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। আর স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি নকশী কাঁথা তৈরী করতে মজুরীসহ খরচ হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট তা বিক্রি করতে হয় ২০০০ টাকায়। এই কাথা ঢাকার বড় বড় বিপনী বিতানগুলোতে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় । পূঁজির অভাবে তারা নিজেরা বাজারজাত করতে পারছেন না এসব পণ্য। ফলে পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনী যথাযথ শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না নারী শ্রমিকরা।

jamalpur 4

হস্ত শিল্প এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, হস্তশিল্প ব্যবসায়িদের পুজি সংকটের কথা মাথায় রেখে পৃষ্টপোষকতায় এগিয়ে এসেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। হস্ত শিল্প ব্যাবসায়ীদের মাঝে চালু করেছে এস এম ই ঋণ কার্যক্রম। আরো অন্যান্য অর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সহায়তা পেলে এখানকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সরাসরি এসব সূঁচি পণ্য ঢাকা সহ বড় শহরে নিজেরাই বিপনন করতে পারবে।

দেশের বাইরেও পণ্যটির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। রফতানি করতে পারবে বিদেশেও। দেশের গার্মেন্ট শিল্পের পরেই জামালপুরের হস্তশিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন হস্ত শিল্প সংশ্লিষ্টরা। হস্তশিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হত দরিদ্র নারী শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের সঠিক শ্রম মূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এই জেলায় গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পুরো পাল্টে যাবে।

Related posts

পরিবার দুষল হুইপপুত্র ও পুলিশ কর্মকর্তাকে

News Desk

দলের সমালোচনা করে বিএনপি নেতা বললেন ‘বহিষ্কার হতে পারি, আই ডোন্ট কেয়ার’

News Desk

যুদ্ধজাহাজের পাহারায় দুবাই নেওয়া হচ্ছে এমভি আবদুল্লাহকে 

News Desk

Leave a Comment