বাগানে থোকায় থোকায় দুলছে গোপালভোগ, খিরসাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, বারি-৪, আম্রপালি, ব্যানানা, ডকমাই, চাকতাসহ হরেক জাতের আম। আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগানগুলোতে এমন দৃশ্য এখন নজর কাড়বে সবার।
আর দিন দশেকের মধ্যেই কিছু জাতের আম পরিপক্ব হয়ে বিক্রির জন্য বাজারে উঠতে শুরু করবে। তাই বাগান মালিক ও চাষিদের এখন বাড়তি নজর পরিচর্যায়। যদিও নানা প্রতিকূলতার কারণে চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন অনেক কম হওয়ার কথা জানান বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। আর কৃষি বিভাগ বলছে, সামনে নতুন কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দিলে উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না।
গুটি থেকে এখন আঁটিসহ পরিপক্ব হয়ে উঠছে ফলের রাজা আম। চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুরু হয়েছে আম পাড়া ও বাজারজাতকরণের প্রস্তুতি। চলতি বছর ফলন কম হলেও এ নিয়ে উৎসাহ আর উদ্দীপনার যেন শেষ নেই। কারণ, এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলই হচ্ছে আম। ইতোমধ্যে বাগানে বাগানে বসছে আমপাড়া ও বাজারজাত করার ঘরও।
এদিকে, আম বাজারগুলোতে আড়ত তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। তবে গত বছরের মতো এবার থাকছে না আম ক্যালেন্ডার। অর্থাৎ আম পাড়ার কোনও সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করবে না প্রশাসন। তবে অপরিপক্ব আম বাজারজাত করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে বাজারে আসবে গোপালভোগ জাতের আম। মে মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যেই গোপালভোগ আম পাকতে শুরু করে। একই সময়ে বাজারে আসবে মহানন্দা ও গুটি জাতের আম।
জানা যায়, বারি-২ বা লক্ষণভোগ ও ক্ষিরসাপাতি আম জুনের প্রথম সপ্তাহে পাকা শুরু হবে। এরপর জুনের মাঝামাঝি সময়ে ল্যাংড়া ও মাসের শেষের দিকে বাজারে আসবে ফজলি আম। এমনকি ফজলি আমের এক সপ্তাহ পর বাজারে আসবে বারি-৪ ও আম্রপালি জাতের আম। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ ও মাঝামাঝি সময়ে আসবে আশ্বিনাসহ আরও কয়েকটি নাবি জাতের আম।
সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের নয়াগোলা এলাকার আম চাষি মোস্তফা জানান, প্রথমে পাকে গোপালভোগ। এর সঙ্গে আরও কিছু গুটি জাতের আম বাজারে আসে। চলতি মৌসুমে গোপালভোগ আম পাড়তে আরও ১২ থেকে ১৫ দিনের মতো সময় লাগবে। মাসের শেষের দিকে এ জাতের আম বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। গুটি জাতের আম এখনো পাকা দেখা যায়নি।’
কানসাটের আম আড়তদার আব্দুল ওয়াহাব জানান, গোপালভোগ আর গুটি জাতের আম একসঙ্গে বাজারে আসে। আমরা বাগান কিনে রেখেছি। সব ধরনের আমের ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। চলতি মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে গোপালভোগ বাজারে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাঈল খান শামিম বলেন, এমনিতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে গোপালভোগ জাতের আম গাছের সংখ্যা কম। এবার আমের অফ ইয়ার, মানে গাছে আম কম। অন্যদিকে, আবহাওয়াগত কারণেও এবার বাজারে আম আসতে দেরি হতে পারে। তিনি আরও জানান, এখন বাজারে পাওয়া অনেক আমই অপরিপক্ব। তবু চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর নামে আম বাজারজাত করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে নজরদারি ও বাজার তদারকি বাড়াতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক জানান, ‘গত কয়েক বছর আমের দাম না পাওয়ায় ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে এ অঞ্চলের চাষিদের। তবে নানা প্রতিকূলতায় আমের উৎপাদন অনেক কম হলেও এবার করোনার প্রভাব ও বাজারজাতকরণে বাধানিষেধ না থাকায় আমের ভালো দাম পাবার আশা করছে আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা।’
এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ বাজারে আমের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিদেশে আম রফতানির পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে নজর দেওয়ার কথা বলছেন উদ্যোক্তা ও আম সংগঠনের নেতারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. ইউসুফ জানান, এ মাসের ২০ তারিখের পর থেকে সবাই আমের স্বাদ নিতে পারবেন। তবে ভালো আম পেতে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ফল একটু আগে ও পরে পাকতে পারে। গত কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে চলতি মাসে আবহাওয়া কিছুটা শীতল থাকলে আম পাকতে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে সঠিক সময়েই আম পাকবে ও বাজারে আসবে।’
এ অবস্থায় আমের ভালো ফলন নিশ্চিতে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষায় বাগান মালিক ও চাষিদের বালাইনাশক স্প্রেসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন ফল গবেষকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, এ বছর গাছ থেকে আম সংগ্রহের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সময় বেঁধে দিলে অনেক ক্ষেত্রে অপরিপক্ব আমও পাড়া হয়। তবে আম ক্যালেন্ডার না থাকলেও অপরিপক্ব আম বাজারজাতের বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারিতে রাখা হবে। এমনকি এনিয়ে কৃষকদেরকে সচেতনও করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশের মধ্যে সুমিষ্ট আম সরবরাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশেষ সুনাম রয়েছে। এই সুনামকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই অন্য জেলার আমে কেমিক্যাল মিশিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বলে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে বাজারজাত করছে। এ বিষয়ে ভোক্তাদের সর্তক থাকার পরামর্শও দেন তিনি।’
তবে আমের উৎপাদনের বিষয়ে কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা জানান, ‘এ বছর আমের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও সামনে নতুন কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দিলে এবারও উৎপাদনে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না।’
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়েছে। জেলায় কৃষি বিভাগ প্রায় ৫৫-৬০ লাখ গাছে চলতি মৌসুমে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন।
গত বছর জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আড়াই লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কৃষি বিভাগের তথ্য মতে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন। যদিও আম চাষি, ব্যবসায়ী ও আম সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন—গত বছর উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন আম।