দেশের ৫৭টি জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার ২১২ জন। মোট প্রার্থী দুই হাজার। অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় প্রার্থী ও ভোটার কম থাকলেও মাঠে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতেও ভোটের মাঠে সংসদ-সদস্যদের বিচরণ, নির্বাচনে টাকা ছড়ানোসহ আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রার্থীকে গুলি করে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে জিডি হয়েছে থানায়। বরগুনার বেতাগীতে ভোটারকে টাকা দেওয়ার প্রমাণ পেয়ে এক সদস্য প্রার্থীকে জরিমানা করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট। মাঠ পর্যায়ের এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাল সোমবার দেশের ৫৭টি জেলা পরিষদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে। শনিবার রাতে শেষ হয়েছে এ নির্বাচনের প্রচারণা। গাইবান্ধা-৫ আসনের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি মনিটরিং করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
Mir Concrete
জানা গেছে এ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা তুলনামূলক কম। গড়ে একটি জেলার ভোটার ১০৫৬ জন। আরও নির্দিষ্ট করলে মাগুরা, জয়পুরহাট ও ঝালকাঠিতে ভোটার সংখ্যা পাঁচশর কম। চট্টগ্রাম জেলায় সর্বোচ্চ ২৭৩১ জন ভোটার আছেন। সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা এই নির্বাচনের ভোটার। এরাই প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচিত করবেন।
নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অনেক জেলা থেকে অভিযোগ এসেছে ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে হবে। আবার কোথাও বলা হয়েছে ভোটের ছবি তুলে আনলে উপঢৌকন দেওয়া হবে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটাররা মোবাইল ফোন নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এসেছিল, সেগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন আনা হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের মতোই ভোট হবে। কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, পার্বত্য তিন জেলা বাদে দেশে ৬১টি জেলা পরিষদ রয়েছে। আইনি জটিলতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত। ফেনী ও ভোলায় চেয়ারম্যান ও সদস্য সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় সেখানে ভোটের প্রয়োজন হবে। বাকি ৫৭ জেলায় কাল ভোট। এ নির্বাচনে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৭ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া সাধারণ সদস্য পদে ৬৯ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ১৯ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। সারা দেশে ৪৫৬টি ভোট কেন্দ্রের ৯১৩টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণ করা হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে উত্তাপ ও অভিযোগ : জেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এক প্রার্থী আরেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ-পালটা অভিযোগ করছেন। শেরপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অভিযোগ-পালটা অভিযোগে সেখানে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হুমায়ুন কবীর রুমানের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানো, সন্ত্রাস, টাকা বিতরণসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পাল। শনিবার শহরের চকবাজারের জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ভোটারদের নানাভাবে প্রভাবিত করতে ভয়-ভীতি দেখানোসহ কালো টাকার প্রলোভনে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে। জেলার বাইরে থেকে অপরিচিত সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোকজন নিয়ে এসে বিভিন্ন নেতাকর্মীদের হুমকি দিচ্ছেন। এ অভিযোগ অস্বীকার করে হুমায়ুন কবীর রুমান বলেন, বাবু চন্দন কুমার পাল তার নিশ্চিত পরাজয় জেনেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন। তিনিই সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করা জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
এদিকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙের অভিযোগ করেছেন জেলা পরিষদের সদস্য পদপ্রার্থী পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহাদাৎ হোসেন ফরিদ। শনিবার নির্বাচনের সবশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। যদিও এ বিষয়ে সামশুল হক চৌধুরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বরগুনার বেতাগীতে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনায় বেতাগী উপজেলার সদস্য প্রার্থী বাবুল আক্তারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও তাকে সতর্ক করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আল নূর। এ বিষয়ে ফয়সাল আল নূর সাংবাদিকদের বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা ২০১৬ এর আলোকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় ভোটারদের টাকা দিয়ে ভোট কেনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রার্থী বাবুল আক্তার। তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে বরগুনার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ভোটারদের টাকা দেওয়ার কিছু কল রেকর্ড আমরা পেয়েছি। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে অর্থদণ্ড দিয়েছেন। প্রার্থী বাবুল আক্তারকে গুলি করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে থানায় জিডি করেছেন তিনি। এ বিষয়ে বেতাগী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম হাওলাদার যুগান্তরকে জানান, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নাহিদ মাহমুদ ওরফে লিটুর বিরুদ্ধে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের আলোকে সঠিক তদন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একইভাবে কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে এক লাখ টাকায় ভোট কেনার অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান মোহনের বিপক্ষে কাজ করায় পৌর শাখার তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ নিয়েও সেখানে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে।
(এ প্রতিবেদন তৈরিতে শেরপুর, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী, বেতাগী (বরগুনা), পটিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধিরা সহযোগিতা করেছেন)।