ক্ষেতজুড়ে লাল লাল টমেটো। কিন্তু তোলা হচ্ছে না। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় সুনামগঞ্জের অধিকাংশ কৃষক ক্ষেতেই ফেলে রেখেছেন কষ্টের এই ফসল। লাভের আশায় চাষ করেছিলেন, কিন্তু বাজারে দুই টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ায় ক্ষেত থেকে তুলছেন না। এতে পচে নষ্ট হচ্ছে। অনেক ক্ষেতের টমেটো খাচ্ছে গরু-ছাগল। ফলে লাভের পরিবর্তে লোকসান দিতে হচ্ছে কৃষকদের। এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তারা।
কৃষকরা বলছেন, সংরক্ষণাগার ও ক্রেতার অভাবে উৎপাদিত এই সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলার কয়েক হাজার চাষি। এসব টমেটো বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে চাইলে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ উঠছে না। ফলে ক্ষেতেই রেখে দিয়েছেন তারা। গত এক মাস ধরে ক্ষেত থেকে টমেটো তুলছেন না। ফলে সেখানেই পচে নষ্ট হচ্ছে। এখন সেগুলো খাচ্ছে গরু-ছাগলে। আশপাশের লোকজনও সেগুলো নিয়ে যাচ্ছেন।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জেলায় দুই হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদরে ১৫০, শান্তিগঞ্জে ১৬৫, দোয়ারাবাজারে ১৭০, বিশ্বম্ভরপুরে ২২০, জগন্নাথপুরে ৭৫, জামালগঞ্জে ৪৭০, তাহিরপুরে ৩১২, ধর্মপাশায় ২৫০, ছাতকে ১৭০, দিরাইয়ে ৫২ ও শাল্লায় ২৫ হেক্টর। সবেচেয় বেশি চাষ হয়েছে জামালগঞ্জে ও কম চাষ হয়েছে শাল্লা উপজেলায়।
মান্নানঘাট, গজারিয়া, কাশীপুর, শরীফপুর, সেলিমগঞ্জ, কালাগুজা, ভুতিয়ারপুর ও রামপুরের অন্তত ১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি মৌসুমে টমেটোর ফলন ভালো হয়েছে। প্রথম দিকে চাহিদা থাকায় ভালোই দাম পেয়েছেন। কিন্তু শেষের দিকে ক্রেতা কমে গেছে। ফলে কয়েকশ মণ পাকা টমেটো ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। কারণ ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে নিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না তারা।
জামালগঞ্জের কাশিপুর গ্রামের চাষি আব্দুল কাদির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতবার টমেটো বিক্রি করে ভালো লাভ হয়েছিল। সে আশায় এবারও বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় চাষাবাদ থেকে শুরু করে সার, খুঁটি, কীটনাশক, শ্রমিক খরচ ও সেচসহ খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। তিন বিঘায় চাষ করে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার টাকার ফলন বিক্রি করেছি। এখনও ক্ষেতে সারি সারি গাছে কাঁচা-পাকা টমেটো ঝুলছে। এক মাস ধরে তুলছি না। ফলে পাকাগুলো ক্ষেতেই ঝরে পড়ে পচে গলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজারে ক্রেতা নেই, চাহিদাও নেই। সরংক্ষণের হিমাগার নেই। সড়ক যোগাযোগ ভালো নয়। এরপরও কষ্ট করে বাজারে নিয়ে গেলে কেজি দুই টাকা দরে বিক্রি করতে হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমাদের ক্ষেত থেকে এক টাকা কেজির বেশি দরে কিনতে চান না।’
একই কথা বলেছেন সংবাদপুর গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে নিয়ে গেলে কেজি দুই টাকায় বিক্রি করতে হয়। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকে কিনলে এক টাকা দেন। ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছি। এখন ঋণের দায়ে এলাকা ছাড়তে হবে। আমরা অসহায়।’
গত এক মাস ধরে টমেটোর দাম পাচ্ছি না উল্লেখ করে একই গ্রামের কৃষক জহিরুল মিয়া বলেন, ‘গত মাসের মাঝামাঝিতে বস্তায় ভরে ইজিবাইক কিংবা ট্রলিতে করে টমেটো বিক্রির জন্য মান্নানঘাট, গোলকপুর ও গজারিয়া বাজারে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে অপেক্ষা পর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি মণ ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এতে পরিবহন খরচ ও শ্রমিকদের মজুরির টাকা ওঠেনি। এরপর থেকে টমেটো ক্ষেত থেকে তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। গ্রামের সব চাষি ক্ষেতেই রেখে দিয়েছেন।’
সংবাদপুর গ্রামের কৃষক শামসু মিয়া বলেন, ‘বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৭৫০ টাকা, আর টমেটোর মণ ৮০ টাকা। ভরা মৌসুমে ভারত থেকে টমেটো আমদানি হওয়ায় আমরা দাম পাচ্ছি না।’
টমেটোর পাশাপাশি কাঁচা মরিচের দাম পাচ্ছেন না বলে জানালেন কাশিপুর গ্রামের কৃষক মঙ্গল মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্ষতির দিকে কারও খেয়াল নেই। সংকট দেখা দিলে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আমরা এখন ৮০০-৯০০ টাকায় মরিচের মণ বিক্রি করছি। এতে অনেক লোকসান হচ্ছে। অথচ কেউ দেখে না।’
সবজির দাম না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সংবাদপুর গ্রামের কৃষক শুক্কুর আলী বলেন, ‘বাজারে চাল-ডাল, তেল, পেঁয়াজ-রসুন ও মাছ-মাংসসহ সব কিছুর দাম বেশি। খালি সবজির দাম নেই। কয়েক মণ টমেটো বিক্রি করে এক লিটার তেল কিনতে হয়। এবার প্রচুর লোকসানে পড়েছি। আাগামীতে আর চাষ করবো না।’
একই গ্রামের চাষি আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘কষ্টের ফসল বাজারে নিয়ে বিক্রি করে শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন খরচ ওঠে না। বিক্রি করতে না পেরে টমেটো ও বেগুন সুরমা নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছি।’
ভাটিয়ালপুর গ্রামের চাষি আব্দুল হালিম বলেন, ‘সবজি আমদানিতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। এই টাকায় যদি সুনামগঞ্জে সবজি সংরক্ষণের হিমাগার করতো সরকার, তাহলে আর আমদানি করতে হতো না।’
ফেনারবাক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সদর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় বিপুল পরিমাণ শীতকালীন সবজি চাষ করেন চাষিরা। উৎপাদিত সবজি জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় যায়। এরপরও উদ্বৃত্ত থেকে যায়। অথচ উদ্বৃত্ত সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নেই। জেলায় একটি হিমাগার নির্মাণ করলে সবজির সংকট হতো না। চাষিরা বছরের পর বছর হিমাগার স্থাপনের দাবি জানিয়ে এলেও কৃষি বিভাগ কোনও উদ্যোগ নেয়নি। এতে প্রচুর সবজি পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোস্তফা ইকবাল আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছর সবজির ভালো দাম পেয়েছেন চাষিরা। তাই এবার ধানের জমিতেও অনেকে সবজি চাষ করেছেন। ফলে বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবে আগাম সবজির ভালো দাম পেয়েছেন। শেষের দিকে দাম পাচ্ছেন না। এজন্য কৃষকদের আগাম জাতের সবজি চাষের পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।’
সবজি সংরক্ষণাগার স্থাপনের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জ বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। তাই হিমাগারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন। বিদ্যুৎ না থাকলে সবজি পচে নষ্ট হবে। ফলে সবজি সংরক্ষণের জন্য সিলেটে একটি হিমাগার স্থাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া আছে মন্ত্রণালয়ে। সেটি পাস হলে চাষিরা সবজি সংরক্ষণ করতে পারবেন। এ ছাড়া আগামী মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রণোদনা দেওয়া হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানিয়েছন, জেলায় এ বছর ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে তিন লাখ ১৯ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন আলু, টমেটো, কাঁচামরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ডাঁটা, ধনেপাতা, মুলা, পুঁইশাক, কলমিশাক, লাল শাক, ক্ষীরা, শসা, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজি উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬৩৯ কোটি টাকা।