মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটের কাছে পণ্যবোঝাই ছোট-বড় ৯টি ট্রাক নিয়ে ডুবে যাওয়া ফেরি ‘রজনীগন্ধা’ দুই দিনেও উদ্ধার হয়নি। তবে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও হামজার সাহায্যে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তিনটি ট্রাক উদ্ধার করা হয়েছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘প্রত্যয়’ নামে আরেকটি উদ্ধারকারী জাহাজ ঘটনাস্থলে নেওয়া হচ্ছে। এটি রাত ১০টা নাগাদ পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, এখনও সন্ধান মেলেনি ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিনচালক হুমায়ুন কবিরের (৩৯)। ফেরি ডোবার সময় অন্যরা সাঁতরে কিংবা উদ্ধারকারীদের মাধ্যমে তীরে ফিরলেও নিখোঁজ হন হুমায়ুন। তিনি বিআইডব্লিউটিসির ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের আরিচা আঞ্চলিক কমিটির দক্ষিণ (পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া) শাখার সভাপতি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে পাটুরিয়া ঘাটের পশ্চিম অংশ থেকে একটি ট্রাক (নম্বর-কুষ্টিয়া ট-১১-২৬৩৩) উদ্ধার করা হয়। এতে কোটি টাকার তুলা ছিল। এ নিয়ে ৯টি যানবাহনের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনটি ট্রাক উদ্ধার হলো। উদ্ধারকাজ রাত ১০টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
দুটি জাহাজ দিয়েও উদ্ধার করা যায়নি ফেরি
বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকালে ফেরি ডুবে যাওয়ার পর দুপুর থেকে উদ্ধারকাজ শুরু করে জাহাজ হামজা। বিকালে ও সন্ধ্যায় দুটি ট্রাক উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় উদ্ধারকাজে যোগ দেয় রুস্তম। এটি বিকাল ৩টার দিকে তুলাবোঝাই একটি ট্রাক উদ্ধার করে। কিন্তু দুটি জাহাজ এখনও ফেরি উদ্ধার করতে পারেনি। ফলে নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘প্রত্যয়কে’ নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ বলেন, ‘৯টি যানবাহনের মধ্যে তিনটি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিনচালক হুমায়ুন কবির। উদ্ধারকাজ অব্যাহত আছে।’
ফেরি উদ্ধার নিয়ে সংশয়
বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডুবে যাওয়া ফেরির ওজন ২৫০ টন। মাটি, পানি ও যানবাহনসহ এর ওজন বর্তমানে ৩৫০ টনের বেশি হবে। কিন্তু জাহাজ রুস্তম, হামজা ও প্রত্যয়ের উদ্ধারের সক্ষমতা ২৫০ টন পর্যন্ত। ফলে ডুবন্ত ফেরি উদ্ধার সম্ভব হবে না। এছাড়া বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী যে কয়টি জাহাজ আছে, সেগুলো দিয়েও ফেরিটি উদ্ধার করা যাবে না।
বিষয়টি স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএর নৌ-সংরক্ষণ সার্ভিসের পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘বুধবার দুপুর থেকে হামজা ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রুস্তম ফেরি উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ফেরিতে থাকা তিনটি ট্রাক উদ্ধার করা হয়েছে। আরেকটি জাহাজ প্রত্যয় আসার পথে। তবে প্রত্যয় দিয়েও ফেরিটি উদ্ধার সম্ভব হবে না। কারণ ফেরির ওজন ২৫০ টন। নদীর তলদেশের বালু, পানি ও যানবাহন মিলে এটির বর্তমানে ওজন কমপক্ষে ৩৩০-৩৫০ টনের বেশি হবে। অপরদিকে, উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়ের সক্ষমতা ২৫০ টন পর্যন্ত। বাকিগুলোরও একই অবস্থা। এক্ষেত্রে আউট অব ক্যাপাসিটি অর্থাৎ বিকল্প সাপোর্ট দিয়ে ফেরি উদ্ধারের চেষ্টা চালাবো আমরা। এতেও সফল হওয়া নিয়ে সংশয় আছে।’
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, ‘ফেরিতে থাকা সবকটি যানবাহন উদ্ধারের চেষ্টা চালাবো আমরা। যদি না পারি, তাহলে ফেরিসহ যানবাহন উদ্ধারে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ফেরিডুবির কারণ জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডুবে যাওয়ার আসল কারণ তদন্ত করে জানাবে কমিটি।’
উদ্ধারকারী জাহাজের সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে মতিউর রহমান বলেন, ‘যে স্থানে ফেরি ডুবেছে সেখানকার পানির গভীরতা ৪০-৪৫ ফুট। ডুবন্ত ফেরির যা ওজন; তা রুস্তম, হামজা ও প্রত্যয়ের সক্ষমতার বাইরে। এগুলো দিয়ে যদি উদ্ধার করা না যায়, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়েছে প্রত্যয়। রাত ১০টা নাগাদ পৌঁছানোর কথা। তবে কুয়াশার কারণে সময় আরও বেশি লাগতে পারে।’
উদ্ধারকাজে ধীরগতির অভিযোগ
ফেরিতে রয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদরের মজিবুল হকের দুটি ট্রাক। তিনি বলেন, ‘দুটি ট্রাক ভুট্টাভর্তি। দুদিন হয়ে যাওয়ায় ভুট্টা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ট্রাক দুটি পেলেই খুশি। কিন্তু উদ্ধারকাজ ধীরগতিতে চলছে। আরও দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানো উচিত।’
কুষ্টিয়ার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ফেরিতে দুটি ট্রাক আছে আমার। এর মধ্যে একটি নিজের আরেকটি ভাড়া করা। দুটিতে তুলা ছিল। ঢাকায় নেওয়া হচ্ছিল। একটিরও সন্ধান পাইনি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টার দিকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসে রজনীগন্ধা। এতে ছোট-বড় ৯টি ট্রাক ছিল। ঘন কুয়াশার কারণে রাত দেড়টার দিকে পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ঘাটের অদূরে পদ্মা নদীতে ফেরিটি আটকে যায়। এ সময় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। বুধবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে তলা ফেটে ডুবে যায় ফেরিটি। তখন যানবাহনের চালক, সহকারী ও ফেরিতে কর্মরত লোকজন দ্রুত নদীতে ঝাঁপ দিয়ে জীবন বাঁচান। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফেরিডুবির কারণ সম্পর্কে জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার বলেন, ‘কী কারণে ডুবেছে, তা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
আরও পড়ুন: ফেরিডুবিতে প্রশাসনের বক্তব্য দুই রকম, প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন ঘটনা ভিন্ন
আরও পড়ুন: ফেরি ডোবার সময় সবাইকে যিনি সজাগ করেছেন তিনিই তীরে ফিরতে পারেননি
আরও পড়ুন: বাল্কহেডের ধাক্কা নাকি তলা ফেটে, কীভাবে ডুবলো ফেরিটি?