রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ৪০টি পরিবার পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ব্যতিক্রমী ঘর। পাহাড়িদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এবার উপহারের জন্য মাচাং ঘর তৈরি করেছে সরকার। আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব পরিবারের মাঝে উপহারের ঘর বিতরণ করবেন।
জেলা প্রশাসন জানায়, দুই শতক জমিসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পাচ্ছে কাপ্তাই উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র ৪০টি পরিবার। পাহাড়ের পরিবেশের উপযোগী করে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেলে মাচাং ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। একেকটি তৈরিতে খরচ হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার ৬৭০ টাকা। তাদেরসহ জেলায় ৬৮০ গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হবে।
কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম এলাকায় ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড়ি সংস্কৃতির আদলে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি। প্রতিটিতে রয়েছে একটি বারান্দা, দুটি কক্ষ ও একটি রান্নাঘর। এর ফলে একদিকে যেমন পাহাড়িদের ঐতিহ্য রক্ষা হবে, তেমনি ঘর দেখে চেনা যাবে অঞ্চল; বিকশিত হবে তাদের সংস্কৃতি।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদিকাল থেকে মাচাং ঘরে বসবাস করেন তারা। পাহাড়ের ভূ-প্রকৃতি বিবেচনা করে নিজেরাই কৌশল খাটিয়ে এসব ঘর তৈরি করে আসছেন। অসমতল স্থানে মাটি না কেটে নির্মাণ করা যায়। এতে পাহাড়ের ভারসাম্য ও পরিবেশ নষ্ট হয় না। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মাটি থেকে তিন-চার ফুট ওপরে গাছ ও বাঁশের খুটির সাহায্যে তৈরি করা যায়। ফলে থাকে না পাহাড়ধসের ঝুঁকি। ঘরের নিচে অনায়াসে হাঁস-মুরগি ও প্রাণী পালন করা যায়। নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের জন্য উপহারের ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলো পেয়ে খুশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো। এরই মধ্যে ঘরে থাকতে শুরু করেছেন উপকারভোগীরা। তবে মঙ্গলবার জমির দলিল ও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চিৎমরম এলাকার বাসিন্দা সাবিত্রী মারমা। যে ভিটাতে ছিল তার ভাঙা ঘর, সেখানেই তৈরি করা হয়েছে মাচাং ঘর। ঘর পেয়ে খুশি হয়ে সাবিত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্ষা এলেই ঘর দিয়ে পানি পড়তো। স্বামী জুম চাষ করে সংসার চালাতে হিমশিম খান। অনেক কষ্ট করে সংসার চলছিল। করার করার মতো সামর্থ্য ছিল না। বর্ষার আগে নতুন ঘর পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করি। তিনি আমাদের পাশে আছেন, আমাদের কথা ভাবেন; এটাই অনেক বড় পাওয়া।’
একই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফুহলাউ মারমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার আগের ঘরটা ভেঙে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নতুন ঘর দিয়েছেন। আমি অনেক খুশি। নতুন ঘরে শান্তিতে বসবাস করছি।’
আমরা আদিকাল থেকে মাচাং ঘরে বসবাস করছি বলে জানালেন চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ক্যা খোঁ মারমা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘নানা কারণে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছিল। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে, তিনি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা ভেবেছেন। দরিদ্র পরিবারগুলো নতুন ঘরে শান্তিতে বসবাস করবে, সেইসঙ্গে ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।’
মাচাং ঘর ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও ব্যয়-সাশ্রয়ী বলে এই অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এই ঘর পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারীদের ঐতিহ্যের স্মারক। একইসঙ্গে দুর্গম এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য ইট, রড ও বালু পরিবহনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। মাচাং ঘর স্থানীয় উপকরণ দিয়েই তৈরি করা গেছে বলে ব্যয় কম হয়েছে। কাপ্তাইয়ে এর আগেও ১৪টি মাচাং ঘর দেওয়া হয়েছিল পাহাড়িদের। আগামী ১১ জুন আরও ৪০টি দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সেখানে বসবাস শুরু করেছেন উপকারভোগীরা।’