জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর আবারও পর্যটক ও বনজীবীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। নিষেধাজ্ঞার ফলে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিতে ফিরেছে নতুন স্পন্দন। দীর্ঘ নীরবতায় জেগে উঠেছে দেশের বৃহত্তম এই বন। সেজেছে আপন রূপে, ফিরেছে সৌন্দর্য। গাছে গাছে বানর ছুটছে অবাধে। স্থানীয় মানুষজন শুনছেন পাখির কলরব। নদীতীরে, জেগে ওঠা চরে দেখা গেছে পাখির ঝাঁক, হরিণেরা ছুটে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। সুন্দরবনের প্রাণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারও ছুটেছে ইচ্ছেমতো, বনরক্ষীদের অফিস পাড়ায় পর্যন্ত দেখা গেছে তাদের।
এরইমধ্যে ব্যস্ততা বেড়েছে সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলের জেলে ও সুন্দরবনের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটরদের। প্রথম দিনেই সুন্দরবনে পর্যটক নিয়ে ভিড়েছে ৯টি জাহাজ। জাহাজগুলোতে দেশি-বিদেশি ৩৪৯ জন পর্যটক ছিলেন।
সুন্দরবনের কোলে থাকা কালাবগি এলাকার লোকজন জানান, বন্ধের মধ্যে চরাঞ্চলে বিভিন্ন প্রাণী দেখা গেছে। বেড়েছে পাখপাখালির কিচিরমিচির। নদী-খালে জলজ প্রাণী দেখা গেছে। দেখা মিলেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। বানর, গুইসাপ, হরিণ দেখা গেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও মনোরম দৃশ্য ফুটে উঠেছে। সুন্দরবনের ভেতরে ও বাইরে জন্মেছে উদ্ভিদের নতুন চারা।
কালাবগি ইকো ট্যুরিজম সেন্টারের স্টেশন মাস্টার আব্দুল হাকিম বলেন, ‘তিন মাসের নীরবতায় সুন্দরবনের পরিবর্তনটা স্পষ্ট উপলব্ধি করা যাচ্ছে। এখন প্রায়ই হরিণের ঝাঁক দেখা মেলে। বনের ভেতর বিভিন্ন স্থানে বাঘের পায়ের নতুন ছাপ দেখা যায়। কখনও বাঘের ডাকও শোনা যায়। গাছপালাও বেড়ে উঠছে। নদী ও খালে মাছের উপস্থিতি বেড়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার ফলে সুন্দরবনের কোলাহলমুক্ত পরিবেশ বন ও প্রাণীর জন্য খুব সহায়ক। এ ৩ মাসে সুন্দরবন সেজেছে নিজের মতো করে। কিন্তু আরও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। আগামীতে তিন মাসের এ নিষেধাজ্ঞাকালে আরও পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক সংমিশ্রণে গৃহীত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারলে আরও জাগ্রত হতে পারে সুন্দরবন।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘মূলত প্রজনন মৌসুম হওয়ায় তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। সেই উদ্দেশ্য পুরোটাই সফল হয়েছে। প্যাট্রোলিং টিমও তৎপর ছিল। ফলে বনে এখন হরিণের শাবক দেখা যাচ্ছে। নতুন গাছপালা জন্মেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, প্রতিবছর সুন্দরবনের প্রজনন মৌসুমে তিন মাস টুরিস্ট ও বনজীবীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সময় বন কোলাহলমুক্ত থাকায় বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজাতি অবাধে চলাফেরা ও নির্বিঘ্নে প্রজনন করতে পারে। ফলে সুন্দরবন এই তিন মাসে প্রাণ ফিরে পায়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে দর্শনার্থী এবং বনজীবীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া দেওয়া হয়েছে। তবে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে চাওয়া বনজীবী ও দর্শনার্থীরা প্লাস্টিকের পানির বোতল, চিপসের প্যাকেটের মতো ওয়ানটাইম ইউজ প্লাস্টিক সাথে নিতে পারবেন না। বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি নেওয়ার সময় পর্যটক, ট্যুর অপারেটর ও বনজীবীদের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে বর্তমানে ১১৪টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দুই লাখ হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, সুন্দরীসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ১৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার জলভাগে কুমির, ৬ প্রজাতির ডলফিনসহ ২৯১ প্রজাতির মাছ রয়েছে। ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবনের বুক চিড়ে রয়েছে ৪০০ নদী-নালা এবং ২০০ খাল। বাঘ, হরিণ, শূকরসহ ২৮৯ প্রজাতির স্থল ও জলজ প্রাণী বাস করে এখানে। আছে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। মাছ ও বন্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হওয়ায় জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ সময়ে বনে প্রবেশ করতে পারেন না জেলে, বাওয়ালি, মৌয়াল কিংবা পর্যটকরা। আর এ সময়টায় নিজেদের আবাসে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় পাখি আর বন্যপ্রাণীরা।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সহসাধারণ সম্পাদক ও এভারগ্রিন ট্যুরসের সত্বাধিকারী মাঝহারুল ইসলাম কচি বলেন, খোলার দিনই ৯টি জাহাজ সুন্দরবন গেছে। এর মধ্যে ৭টি খুলনার, ১টি মোংলার ও ১টি ঢাকার। তিনি বলেন, সাগর উত্তাল থাকায় এখন হিরনপয়েন্ট ও দুবলার চর যাওয়ার সুযোগ নেই। ১ নভেম্বর থেকে ওই দুই জায়গার যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। তাই, এখন জাহাজগুলো করমজল, হারবারিয়া, কটকা, কচিখালী ও ডিমেরচর রুটে যাতায়াত করবে।