চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের গুটি ঝরে পড়ছে। এতে উৎপাদন কমার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ ও চাষিরা।
বাগান মালিক ও চাষিরা জানিয়েছেন, এ বছর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী অঞ্চলের আম বাগানে মুকুল আসতে শুরু করেছিল। অনেক গাছে মুকুল এসেছিল দেরিতে। তবু শেষ পর্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু টানা তাপপ্রবাহের কারণে এখন ঝরে পড়ছে আমের গুটি। এরই মধ্যে অনেক বাগানের অন্তত ২০ শতাংশ গুটি ঝরে গেছে। অনেক গাছে এখন শুধুই পাতা। একটি গুটিও নেই। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১৭ এপ্রিল থেকে রাজশাহীতে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। সেদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮ এপ্রিল ছিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রবিবারও তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে এই তাপমাত্রা।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর; চার জেলায় ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম বাগান আছে। এ বছর জেলাগুলোতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১২ লাখ ৭ হাজার ২৬৩ টন।
চারঘাট উপজেলার আমানুল হকের ১০ বিঘা জমিতে আমের বাগান আছে। তিনি বলেন, ‘এবার সব গাছে মুকুল কম এসেছিল। যেটুকু ছিল, তা নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে তীব্র গরমে অধিকাংশ গাছের গুটি ঝরে গেছে। অনেক গাছ গুটিশূন্য হয়ে আছে। এতে উৎপাদন অনেক কম হবে।’
বাঘা উপজেলার শফিকুল ইসলাম সানা গত বছর এক কোটি টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। এর মধ্যে ২৬ মেট্রিক টন বিদেশে রফতানি করেছিলেন। এবার ৩০০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। গাছে গুটি কম থাকায় হতাশা ও দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর প্রচুর আম হয়েছিল। সে তুলনায় এবার অনেক কম পাবো। অধিকাংশ গুটি ঝরে গেছে। ফলনে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে।’
এবার কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার লাউঘাট্টা এলাকার আম চাষি মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এবার বাগানের ৭০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। মার্চ মাসের ২০ ও ২১ তারিখে যে বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে সব মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। এরই মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহে যেসব গুটি ধরেছিল তার সিংহভাগ তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে। এতে খরচ উঠবে বলে মনে হয় না।’
খরায় গুটি ঝরে পড়ারোধে করণীয় কী জানতে চাইলে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খরা দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকলে গুটিও ঝরতে থাকবে। সেক্ষেত্রে বাগানে ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। পাশাপাশি কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
তবে আম চাষিরা বলেছেন, বর্তমানে জেলার সব আম বাগানে সেচের দরকার হলেও অনেক জায়গায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ দিতে পারছেন না চাষিরা। এতে উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর এলাকার আম চাষি শাহাদ হোসেন বলেন, ‘চলতি বছর ছয় বিঘা জমিতে আম বাগান করেছি। অল্প পরিমাণ গুটি এসেছিল। সেগুলো ধরে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। প্রতিদিন সেচ ও কীটনাশক স্প্রে করছি। এরপরও গুটি ঝরে পড়ারোধ করতে পারছি না। এতে ফলনে বিপর্যয় ঘটবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রানিহাটি এলাকার এখলাসুর রহমান বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৯ বিঘার একটি বাগান কিনেছি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায়। সেই বাগানে মুকুল ও গুটি কম এসেছে। এতে দুই লাখ টাকার আম উৎপাদন হবে না। চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। অনেক স্থানে পানি নেই, সেচ দিতে পারছি না।’
গুটি ঝরে পড়ারোধে করণীয় সম্পর্কে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চাষিদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে গাছ পরিচর্যা করতে হবে। এক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। পাশাপাশি নানা ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। মোটকথা, গাছের গোড়া ভিজিয়ে রাখতে হবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. পলাশ সরকার বলেন, ‘চলতি মৌসুমকে আমের অফ-ইয়ার ধরা হয়েছে। কারণ গত বছর প্রচুর পরিমাণ আম উৎপাদন হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এবার উৎপাদন কম হবে। তাই মুকুল ও গুটি কম এসেছে। সেই গুটি টিকিয়ে রাখতে মাঠপর্যায়ে চাষিদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মাহমুদুল ফারুক বলেন, ‘এবার নওগাঁয় নতুন আম বাগানে প্রচুর মুকুল এসেছিল। সে তুলনায় কম মুকুল এসেছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গাছগুলোতে। গত বছর যেসব গাছে প্রচুর আম ধরেছিল, সেসব গাছে এবার কম ফল ধরতে পারে। কারণ আবহাওয়া পরিস্থিতি, পরাগায়নের সমস্যা ও রোগবালাই ইত্যাদির ওপর উৎপাদন নির্ভর করে। সাধারণত ২০ শতাংশ গাছে এক বছর পরপর ফল আসে। এজন্য ফলন কমবেশি হয়ে থাকে।’
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আমের উৎপাদন কম হবে বলে জানালেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এবার আমের উৎপাদন কম হবে। অনেক মুকুল ও গুটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে টানা খরার পাশাপাশি পরাগায়নে সহায়ক সিনফিড মাছি যথেষ্ট পরিমাণ দেখা যায়নি। গত মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছিল। এবার বেশিরভাগ গাছে নতুন পাতা গজেছে। তাতে আশা করছি, আগামী মৌসুমে আমের ভালো ফলন হবে।’