একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। মূলত বাস্তব ঘটনা। আমার এক সাবেক কর্মীর মুখে শোনা। তিনি থাকেন মগবাজারের দিকে। নিজেই রান্নাবান্না করেন। তাঁর নিচের তলায় আরেকটি পরিবার ভাড়া থাকে। কিন্তু করোনায় ওই পরিবারের কর্তার চাকরি চলে যায়। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারটির চোখে অন্ধকার নেমে আসে। শেষপর্যন্ত উপায় না দেখে কর্তাকেই তাঁর স্ত্রী আমার সেই কলিগের কাছে পাঠালেন। না, কোনো অর্থ সহায়তা চাওয়ার জন্য নয়। প্রতিবেশী যেহেতু নিজেই রান্নাবান্না করেন ফলে ওই গৃহকর্ত্রী তাঁর স্বামীকে পাঠিয়েছেন, দুইবেলা রান্নার দায়িত্ব তাঁকেই দিতে। বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা দিলে হবে। তিনি নিজে বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন বলে বা প্রতিবেশী কী না কী মনে করেন, এর জন্য স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন এই প্রস্তাব দিতে। তার মানে পরিস্থিতি এমন, একটি মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের কর্ত্রীকে প্রতিবেশীর গৃহপরিচারিকা হতেও বাধ্য করছে, সোজা বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘রান্নার বুয়া’। আমি এই কাজকে কোনোভাবেই ছোট করছি না। সেই নারীকে অবশ্যই বাহবা দিতে হয় এই জন্য যে, জীবিকার তাগিদে আরেকজনের বাসায় রান্নার কাজ করতেও তাঁর মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি।
করোনা পরিস্থিতি এভাবে কত পরিবারকে পথে নামিয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রণোদনা কারা পেয়েছে তো আমরা জানিই। গরিবের জন্য সরকারের বস্তা বস্তা চাল আর বোতলের পর বোতল সয়াবিন তেলের ‘গুপ্তধন’ কাদের খাটের তলায় আবিষ্কার হয়েছিল তাও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। মোবাইলে গরিবের জন্য পাঠানো টাকাও কাদের পকেটে ঢুকে গিয়েছিল, সে কথাও। মাঝখানে অক্সিজেনের সিলিন্ডার, হাসপাতাল, আইসিইউ সিট এবং কবরস্থানে লাশ নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে অনেকে সেসব কথা ভুলে গিয়েও থাকতে পারেন। তবে রেহাই নাই গোলাম হোসেন! আপনাকে কোনোভাবেই ভুলতে দেওয়া হবে না যে, এ রাষ্ট্র বাহাদুরের দয়া-দাক্ষিণ্যেই যেন আপনি বেঁচে আছেন। জ্বালানির তেল বাড়ছে তো পরিবহন ভাড়া বাড়ছে, বাড়ছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম, ভরা মৌসুমে শীতের সবজির দামও। ভোজ্য তেলের দাম তো বাড়ানো হচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি আবারও সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, লিটারে ৮ টাকা।
করোনাকালের মাঝামাঝিতেও যেখানে সয়াবিন তেল লিটার প্রতি দাম ছিল একশ দশ টাকা। সেটি এখন ১৬৮ টাকা। এটি অবশ্যই সরকার নির্ধারিত দাম। যদিও সেটি মানতে বাধ্য বলে মনে করেন না তেল ব্যবসায়ীরা! নিজেরাই এক টাকা দুই টাকা তিন টাকা করে বাড়িয়ে, বিষয়টাকে স্বাভাবিক করে ফেলে একপর্যায়ে সরকারি ঘোষণা আদায় করে দেন। সরকারও দুই একদিন হুমকি-ধমকি দেবে, এরপরে বৈঠক ডেকে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাপূরণ করে দেবে। এবারও সেটি দেখতে পেলাম আমরা। আন্তর্জাতিক বাজারের হিসাবনিকাশ দেখিয়ে শুধু তেল নয়, অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এমন নাটকই আমরা দেখে যাচ্ছি, দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো হয়ে গেছি অনুভূতিশূন্য। সেই সুযোগে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও বলে দিলেন, ‘এত দাম বাড়ার পরেও দেশে কোনো হাহাকার নেই, মানুষের কষ্ট নেই’ (সময় নিউজ, ৮ ফেব্রুয়ারি)। আগে তো নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিল মিটিং দেখা যেত। এখন সেসবও হারিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বিশ্বের কোন দেশে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ বিক্ষোভে কোন সরকারের কী হলো, সেসব খবর বা ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হাহুতাশ মেটাই।
গত বুধবার প্রথম আলোর পাতা উল্টিয়েই আমরা দেখলাম, দেশের মাথাপিছু আবার বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আয় এখন ২,৫৯১ ডলার। কিছুদিন পর পর মাথাপিছু আয় বাড়ার এমন খবর আমরা পাচ্ছি। এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-সাংসদের গর্বেরও সীমা নেই। একইদিন আরেকটা খবর হলো, ঢাকায় গরিবের বাজারখ্যাত তেজগাঁও এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষদের এক বাজারে ১০ টাকায় সয়াবিন তেলের পুঁটলিও আর নেই, সেটি এখন হয়ে গেছে ২০ টাকা। দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, ছোট দোকানদারদের কাছে ভরসা এই বাজার। কারণ, সেখানে প্রায় নিত্যপণ্য অল্প পরিমাণে দশ টাকা দামে পাওয়া যায়। কোনোমতে জীবনধারণের এই বাজারে এখন সয়াবিন তেলের দামও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেখানেই এক ক্রেতা পোশাক শ্রমিকের বক্তব্য, ‘দুই বেলা খাওনে যা যা লাগে, সবকিছুরই দাম বেশি। করোনার চেয়েও এহন আরও বেশি কষ্টে আছি।’ এ বিষয়টাই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এক সাক্ষাৎকারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, করোনা আমাদের মানুষকে হার মানাতে না পারলেও, দুর্বল করতে না পারলেও সেটিই এখন হতে যাচ্ছে।
গত মাসে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নাজমুল হক খান নামে এক তরুণের তোলা এক ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। যাতে দেখা যায়, ফুটপাতে সয়াবিন তেলের অনেকগুলো খালি বোতল পড়ে আছে। সেগুলোর তলায় থেকে যাওয়া ফোঁটা ফোঁটা তেল সংগ্রহ করে ছোট বোতলে ভরছেন দিনমজুর। এক ফোঁটা তেলের জন্য কী এক হাহাকার যেন। কথা হচ্ছে, তার মাথাপিছু আয় কোথায় গেল?
এলাকায় এলাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের সারি দীর্ঘই হচ্ছে। অল্প কিছু কম দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবির চলন্ত গাড়িতে পর্যন্ত হামলে পড়ছে মানুষ। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তোলা এমনই এক ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে। সকাল আটটা থেকে মানুষগুলো লাইনে দাঁড়িয়েছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দুপুর। তখনো টিসিবির গাড়ি আসে না একপর্যায়ে চোখের সামনে টিসিবির গাড়ি যেতে দেখে মানুষ রীতিমতো দিশেহারা যেন। এই দৃশ্য দেখে সরকারের দু-একজন মন্ত্রী হয়তো কিছুটা নাখোশই হবেন। কারণ, দেশ যেখানে কখনো সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে, কখনো প্যারিস বা কখনো লস অ্যাঞ্জেলস হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কম দামে চাল-ডাল-তেল কেনার জন্য এমন কামড়াকামড়ি কেন?
পেঁয়াজের দাম যখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেল, তখন পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি দিতে থাকল সবাই। সরকারের দায়িত্বশীল লোকদেরও বলতে দেখলাম, তরকারিতে পেঁয়াজ না হলে কী হয়! সেকথা মনে পড়তেই ভাবছি তাঁদের কেউ না আবার বলে বসেন, রান্নায় তেল না হলে কী হয়, পানি দিয়েই তো সে কাজ সারা যায়!
একের পর এক মেগা প্রকল্প হচ্ছে। মাটির ওপরে নিচে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হচ্ছে। কিছু মানুষের ফুলেফেঁপে কলাগাছ থেকে বটগাছ হয়ে যাচ্ছে।অন্যদিকে মহামারিতে বিপর্যস্ত মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু আয়ের কিসসা শুনিয়ে। গতকাল বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে তেমনটিই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, ‘গড় মাথাপিছু আয়ের কথা বলে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। যারা এই হিসাব দেন, জনগণের সঙ্গে তাদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। তারা গ্রামে থাকেন না। গরিব মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের হাতেই অর্থ। এটা একটা ভয়ংকর অবস্থা। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলে আমাদের ঘুমপাড়ানি গান শোনানো হয়। তারা বেগম পাড়ায় টাকা পাচারের আনন্দে আছেন। তারা বলবেই যে, দেশ উন্নত হচ্ছে। কারণ তাদের অর্থ সম্পদ বাড়ছে। দেশের অবস্থা তেমন একটা ভালো না।’
নিত্যপণ্যের দাম কমানোর কার্যকরী কোনো উদ্যোগই দেখা গেল না গোটা করোনাকালে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। এত এত উৎপাদনের মধ্যেও বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাইছে সরকার। ১২ বছরে তেরোবার পানির দাম বাড়িয়ে আবারও বাড়াতে এক পায়ে খাঁড়া ঢাকা ওয়াসার সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বেতনধারী এমডি। এসব কিছু নিয়েই গতকাল বৃহস্পতিবার দৈনিক সমকাল শিরোনাম করেছে, ‘সংসার চালানোই দায়’। ফসল উৎপাদন করে দাম পায় না কৃষক। সেই ফসলই আবার বাজারে কিনতে গেলে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে তাঁকে। কোথায় যাবে মানুষ? আন্তর্জাতিক এত এত র্যাংকিংয়ের দেশের সাফল্য দিয়ে কী হবে, যদি ঠিকমতো পেটটাই চালানো না যায়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কেমন চলছে বাংলাদেশ, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধ হয় আর হয় না।