অরক্ষিত অবস্থায় কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রে অবহেলিতভাবে রয়েছে নজরুলকে পালিত বংশধররা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাল্য বিজড়িত ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার কাজীর শিমলা গ্রামের রফিজউল্লাহ দারোগাবাড়ি। যেখানে কেটেছে কবির শৈশব জীবন। কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতেই সেখানে গড়ে তোলা হয় কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে আছে মোট দুটি স্মৃতিকেন্দ্র। আরেকটি হলো— বিচুতিয়া বেপারিবাড়িতে।
নজরুলের যেখানে বেড়ে ওঠা, এই দুই পরিবার এখন অবহেলিত। কবির নামে ত্রিশালে বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি স্কুল থাকলেও রফিজউল্লাহ দারোগা ও বিচুতিয়া বেপারির বংশধররা অবহেলায়-অনাদরে আছেন। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার মতো কেউ নেই। শুধু নজরুলের জন্মবার্ষিকী এলে কেউ কেউ তাদের ডাকেন। এ ছাড়া সরকারিভাবে তাদের ভাতা ব্যবস্থার কথা বললেও এখনও তার ব্যবস্থা করা হয়নি। অথচ তাদের বংশধররা কবির স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্মৃতিকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছেন নিজেদের জমি।
রফিজ উল্লাহ দারোগা বাড়ী স্মৃতিকেন্দ্র এখন অরক্ষিত। মুছে যেতে চলেছে কবির স্মৃতি। স্মৃতিকেন্দ্র ভবনে ঢোকার পর ডান পাশেই দেখা গেল একটি খাট। তার গায়ে ধুলার পুরু আস্তর। এতই ধুলো পড়েছে যে কাঠের তৈরি খাটের আসল রঙই আর চেনা যাচ্ছে না। খাটের পায়াগুলো আবার ক্ষয়ে গেছে। দোতলা ভবনে পাঠাগার থাকলেও নেই কোনো পাঠক। সেখানে আছে প্রায় পাঁচ হাজার বই। চেয়ার টেবিলগুলো পড়ে আছে খালি অবস্থায়।
কবি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ২০০৮ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট এটি স্থাপন করে। সেখানে এভাবেই রাখা আছে জাতীয় কবির ব্যবহৃত এই স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু এগুলোতে কবির স্মৃতির দেখা পাওয়াই দুষ্কর। সম্বল বলতে ওই একটি খাট আর কিছু ছবি। রফিজ উল্লাহ দারোগাবাড়ি থেকে দরিরামপুর হাইস্কুলের দূরত্ব ছিল অনেক, তাই কবিকে বিচুতিয়া বেপারিবাড়িতে জায়গির থাকতে হয়। বিচুতিয়া বেপারিবাড়িতে রয়েছে আরেকটি স্মৃতিকেন্দ্র। কবি নজরুল যে ঘরে থাকতেন, ঘরটি থাকলেও রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। ফ্লোর পাকা থাকলেও উইপোকা মাটিতুলে বাসা বেঁধেছে। ওইখানেও নেই আর কোনো কার্যক্রম।
১৯১৪ সালে ত্রিশালে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ছিলেন প্রায় এক বছর। তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন কাজী রফিজউল্লাহ। এই ব্যক্তি ছিলেন পেশায় দারোগা। তার বাড়ি ছিল ত্রিশালের কাজীর শিমলায়। নজরুলকে সেখানকার দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন তিনি। নজরুল সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। রফিজউল্লাহর গ্রাম কাজীর শিমলা থেকে দরিরামপুর স্কুলের দূরত্ব ছিল অনেকটাই। প্রতিদিন সেই স্কুলে আসা-যাওয়া করা নজরুলের জন্য কঠিন ছিল। তাই স্কুলের কাছাকাছি বিচুতিয়া বেপারিবাড়িতে জায়গির থাকতে হয়েছিল তাকে।
নজরুলকে পালিত বিচুতিয়া বেপারির বংশধর হাফেজ আবুল কাশেম জানান, আমাদের বাপ-দাদারা নজরুলকে লালনপালন করেন। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমরা জমি দিয়েছি। কিন্তু আমরা অবহেলিত। আমাদের খোঁজখবর কেউ রাখে না। নজরুলের বংশধর হিসেবে সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা ও একটি কর্মের ব্যবস্থা করলে আমরা চলতে পারি। আমাদের ভাতা দেওয়ার কথা থাকলেও তারও কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণ সহকারী ও স্মৃতিকেন্দ্রের বই বিক্রির দায়িত্বে থাকা মো. ফয়জুল্লাহ রোমেল বলেন, পাঠাগারে বই পড়তে খুব বেশি কেউ আসে না। স্মৃতিকেন্দ্রে দর্শনার্থীও আসে কদাচিৎ। মাসে ২০-৩০ জনের বেশি হয় না।
স্মৃতিকেন্দ্রের লাইব্রেরি সহকারী রাসেল হোসাইন বলেন, প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় লোকজন অনেক কম আসে। আর এ কেন্দ্রটি ডিজিটাল ও কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে মানুষের সমাগম বাড়বে। নজরুলের খাটটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্যারকে জানিয়েছি।
দুই স্মৃতিকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, বিচুতিয়া বেপারিবাড়ির এটিই মূল অফিস। এখান থেকেই দুই স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই কেন্দ্রের দোতলার একটি অংশে আছে পাঠাগার। আর আরেকটি অংশে আছে নজরুলের কিছু ছবি ও হাতে লেখা গান। সেগুলো ফ্রেমে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নজরুলের ব্যবহৃত একটি টিনের ঘর রয়েছে।
নজরুলের খাটটি সংরক্ষনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করা হবে। এই স্মৃতিকেন্দ্রগুলোরও সংস্কার করা হবে। এ ছাড়া নতুন প্রকল্পের আওতায় স্মৃতিকেন্দ্রে একটি নতুন নজরুল কর্নার তৈরির কথা আছে। ঢাকায় থাকা জাতীয় কবির জাদুঘর থেকে কিছু দর্শনীয় জিনিস এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি।