চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিস ফি কমানোর আন্দোলন থেকে গ্রেফতারের পর শিক্ষার্থী মোস্তাকিমকে থানায় নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার সাবেক ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার ও সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দুপুরে অতিরিক্ত চিফ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ারের আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘থানায় মোস্তাকিমকে নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার সাবেক ওসি ও এসআইয়ের বিরুদ্ধে করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল সিআইডি। আমরা সেই প্রতিবেদনের বিপক্ষে নারাজি দিয়েছিলাম। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আমাদের আবেদন খারিজ হয়ে গেলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করি। আদালত আজ শুনানি শেষে সাবেক ওসি এবং এসআইয়ের বিরুদ্ধে করা মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তার মাধ্যমে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মোস্তাকিম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ অক্সিজেন এলাকার মৃত খালেদ আজমের ছেলে। চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় ফাজিল শেষ বর্ষে পড়ার পাশাপাশি সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজে ইসলামের ইতিহাসে অনার্সে পড়ছেন। তার ৫৫ বছর বয়সী মা নাসরিন আক্তারের দুটি কিডনিই বিকল ছিল। তাকে সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হতো। সাত বছর ধরে এভাবে ডায়ালাইসিস করে বেঁচেছিলেন। একমাত্র অবলম্বন ছিল ২২ বছর বয়সী মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে মুস্তাকিম। তার টিউশনির টাকাতেই নাসরিনের ডায়ালাইসিসের খরচ চলতো। মুস্তাকিমের মা গত বছরের ১৬ জানুয়ারি মারা যান। যে মায়ের জন্য তার এতো সংগ্রাম সেই মাকে আর বাঁচাতে পারেননি তিনি।
২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি বাড়ানোর প্রতিবাদ করেন মুস্তাকিম। এ ঘটনার পর সেদিনই পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মুস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় মুস্তাকিমকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মুস্তাকিমের জামিনের জন্য লড়ে। পাঁচ দিন কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান।
১৬ জানুয়ারি পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। তার অভিযোগ, ১০ জানুয়ারি ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়। ঘটনার দিন থানায় নেওয়ার পর মুস্তাকিমকে লাঠিপেটা করা হয়। একটি নির্জন কক্ষে আটকে রেখে ওসির নির্দেশে মারধর করেন এসআই আবদুল আজিজ। অভিযোগে আরও বলা হয়, পুলিশের নির্যাতনে মুস্তাকিমের পায়ের গোড়ালি থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত, শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল দাগ হয়ে যায় । দুই দিন তার প্রস্রাব বন্ধ থাকে। পরে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য ক্রসফায়ারের হুমকি দেয় পুলিশ। পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলার আবেদন করেছিলেন মুস্তাকিম। পরে মামলাটি পাঁচলাইশ থানার পুলিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। একইসঙ্গে সিআইডিকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। সিআইডি তদন্ত শেষে গত বছরের ১১ মে এই মামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। আদালত তা গ্রহণ করেন। সিআইডির দেওয়া প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন মুস্তাকিম।
নির্যাতনের শিকার মুস্তাকিমকে আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সেখানে আবেদন খারিজ হলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করা হয়। মহানগর দায়রা জজ এটি শুনানির জন্য আবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠান। সেখানে শুনানি শেষে বাদীর নারাজি আবেদন গ্রহণ করে পিবিআইতে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন: ‘হাজতে আমাকে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না’