নীলফামারীতে ১০ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা একটি নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। অথচ এখানে একটি ব্রিজ হলেই পাল্টে যেতে পারে ১০ গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা। সাঁকোটি নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের বসুনিয়ার ডাঙার দেওনাই নদীর ওপরে অবস্থিত। বিকল্প রাস্তা না থাকায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেলা শহরে যাতায়াত করেন গ্রামের বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাঁকোর ওপর দিয়ে পার হয়ে প্রতিদিন নীলফামারী জেলা শহরে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় যাতায়াত করেন হাজারো শিক্ষার্থী। দেওনাই নদী পেরিয়ে বাঁশদাহ, লক্ষ্মীচাপ, শিমুলবাড়ী, ধর্মপাল, দুবাছুরি, দাঁড়িহারা, বালারপুকুর, খেরকাটি, অচিনতলা ও শেওটগাড়ী গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও কষ্ট করে ওই বাঁশের সাঁকো দিয়ে জেলা শহরে যাতায়াত করছেন। এতদিন পেরিয়ে গেলেও কেউই শোনেনি তাদের কথা।
সাঁকোর রাস্তাটি লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন থেকে গিয়ে জেলার বিভিন্ন বড় বড় সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। গ্রামের ব্যবসায়ীদের মালামাল পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকোটি যেন মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে রোগী পরিবহনে পোহাতে হয় ভোগান্তি। বিশেষ করে নীলফামারী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে অসুস্থ শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের নিয়ে যেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
জেলার জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলবাড়ী গ্রামের রশিদুল ইসলাম (৫৭) বলেন, ‘জলঢাকায় বাড়ি হলেও সীমান্তঘেঁষা নীলফামারী শহর। নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের চাহিদা জেলা শহর থেকে পূরণ করতে হয়। তাই ব্রিজটি আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। ভরা বর্ষায় সাঁকো ভেঙে মাঝেমধ্যে লোকজন নদীতে পড়ে যায় এবং আহত হয়। গ্রামের উৎপাদিত ফসল জেলা শহরে বাজারজাত করা মোটেই সম্ভব হয় না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। তারপরেও দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষজন অনেক কষ্টে যাতায়াত করেন। একটি ব্রিজের জন্য জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দফতরে ধরনা দিয়েও এখন পর্যন্ত কোনও প্রতিকার পায়নি তারা। এ ছাড়াও নদীর কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে লক্ষ্মীচাপ কাচারি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা।’
লক্ষ্মীচাপ কাচারি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কমর উদ্দিন বলেন, ‘বাঁশের সাঁকোটি ১০ গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। চলতি বর্ষায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমতে শুরু করেছে। এতে করে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আশানুরূপ ফলাফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। এ ছাড়াও শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে চিন্তিত থাকেন অভিভাবকরা।’
নদীর তীরবর্তী বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ রায় (৫৬) বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে বসুনিয়ার ডাঙ্গা দেওনাই নদীর ওপর ব্রিজ নাই। এলাকাবাসী প্রতিবছর বর্ষা এলে বাঁশ, কাঠ ও চাঁদা সংগ্রহ করে সাঁকোটি মেরামত করেন। প্রতিদিন এটি দিয়ে হাজার হাজার লোক যাতায়াত করেন। অথচ ভোটের সময় অনেকেই ব্রিজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে যায়, কিন্তু ভোট চলে গেলে আর কারও কোনও খবর থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিকল্প রাস্তা না থাকায় জেলা শহরে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা এই বাঁশের সাঁকো। এখানে বাঁশের সাঁকোর পরিবর্তে একটি ব্রিজ হলে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে। জেলা শহরে উন্নত চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে যেতে হয় নীলফামারী জেনারেল হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ডিসি অফিস, জজ কোর্ট, পাসপোর্ট ও ভূমি অফিসসহ অন্যান্য অফিসে।’
লক্ষ্মীচাপ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী পারুল রানি ও সুমিত্রা রানি বলেন, ‘আমরা এই সাঁকো দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাতায়াত করি। মাঝেমধ্যে সাঁকো ভেঙে নদীতে পড়ে আহত হওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটে। বর্ষার সময় ভেলায় চড়ে আসতে হয় স্কুলে। অনেক সময় নদীতে পড়ে বই-খাতা ও স্কুলের ইউনিফর্ম ভিজে যায়। পাঠ্যসূচি মেলাতে অনেক সমস্যা হয় আমাদের। নদীর অপর পাড়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা থমকে দাঁড়ায়। এতে ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে না অনেকেই। আমাদের দাবি, দেওনাই নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করে দেওয়া হোক।’
লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, ‘সাঁকোটি মানুষের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন এই সাঁকোর ওপর দিয়ে অনেক মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে জেলা শহরে যাতায়াত করতে হয়। দেওনাই নদীর ওপরে একটি ব্রিজ হলে হাজারো মানুষের যাতায়াতের সুবিধার পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হতো। উপজেলার মাসিক মিটিংয়ে কয়েকবার এই ব্রিজের প্রস্তাব তোলা সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি।’
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজ হাসানের সঙ্গে কথা হলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। তাই সেখানে দ্রুত লোক পাঠানো হবে।’