কেউ পেঁয়াজ, কেউ আলু ও বেগুনি কাটছেন। আবার কেউ আলু, বেগুনের চপ বানাচ্ছেন। ইফতারের জন্য তৈরি করা এসব পেঁয়াজু, চপ, ছোলাসহ অন্যান্য সামগ্রী দোকানে নিয়ে আসছেন কেউ কেউ। দোকানের পাশেই ১৬ কর্মচারী ব্যস্ত ইফতারি তৈরিতে। অন্যরা ব্যস্ত বিক্রিতে।
বুধবার (১৩ এপ্রিল) বেলা ১১টায় গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজারের ফল পট্টিতে ইফতারি বিক্রেতা মাসুদ খানের দোকানে গিয়ে এই কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। রোজার মধ্যে দিনে গড়ে এক লাখ টাকার ইফতারি বিক্রি হয় মাসুদ খানের দোকানে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পেঁয়াজু।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডালের বড়া, আলুর চপ, ছোলাসহ নানা জাতের ভাজা-পোড়া তৈরি ইফতার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একের পর এক ক্রেতারা পছন্দের জিনিস কিনছেন। অন্যান্য সময় সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এসব খাদ্য তৈরি ও বিক্রি হলেও রোজার সময় শুধু ইফতারকে কেন্দ্র করে তৈরি ও বিক্রি হয়ে থাকে।
এলাকাবাসী জানান, বাবা মারা যাওয়ার পর আট ভাইবোনসহ মায়ের ভরন-পোষণের দায়িত্ব পড়ে মাসুদ খানের ওপর। ফুটপাতে পেঁয়াজু, চপ বিক্রির মাধ্যমেই সংসারের হাল ধরেন। অল্পদিনের মধ্যে তার তৈরি খাবারের স্বাদের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কালিয়াকৈরসহ আশপাশের এলাকার হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন তার তৈরি পেঁয়াজুসহ চপের স্বাদ নিতে।
সুত্রাপুর এলাকার বিজয় চন্দ্র সরকার বলেন, ‘মাসুদ খানের পেঁয়াজুর স্বাদ ভালো, সবাই জানে।’ কল্পনা রানি বলেন, ‘সারা বছরই তার দোকানে পেঁয়াজুসহ নানা জাতের ভাজা-পোড়া খাবার তৈরি করা হয়। স্বাদের হওয়ায় তার মতো আরও অনেকে এসব খাদ্য উপাদান কিনতে আসেন।’
স্থানীয়রা জানান, অন্য ব্যবসায়ীরাও তার মতো এসব খাবার বিক্রি করেন। কিন্তু তার তুলনায় ওইসব ব্যবসায়ীদের বিক্রি অনেক কম। কালিয়াকৈর উপজেলার বাইরের লোকজনও তার দোকানের পণ্য কিনতে আসেন। বিশেষ করে মাসুদ খানের পেঁয়াজুর সুনাম রয়েছে এলাকাজুড়ে। পেঁয়াজু বিক্রি করে তিনি এখন কোটিপতি। দীর্ঘদিন যারা তার দোকানে কাজ করছেন তারাও ভালো অর্থ উপার্জন করছেন।
কালিয়াকৈরের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক হাজেরা খাতুন বলেন, ‘পুষ্টিগুণের কথা জানি না। তবে খেতে ভালো লাগে। তাই মাঝেমধ্যে কিনে খাই। কিন্তু বেচাকেনা যেহেতু ভালো এবং মানুষের চাহিদা বেশি সে কারণে খাদ্যের স্বাস্থ্যমান বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যগুলো ঢেকে রাখা উচিত।’
কারিগর দুলাল মিয়া জানান, সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। রমজান মাসে বেতন বেশ ভালো পাওয়া যায়। অন্য মাসেও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করা হয়।
ওই দোকানে কাজ করা আইয়ুব আলী জানান, গত ১০ বছর ধরে এই দোকানে পেঁয়াজু তৈরির কাজ করছেন। অন্য মাসে তার বেতন৩০ হাজার টাকা, কিন্তু রমজান মাসে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
দোকানের ম্যানেজার আমির উদ্দিন জানান, ২০ বছর ধরে মাসুদ খানের দোকানে কাজ করছেন। তিন কন্যার বিয়ে দেওয়া এবং তিন তলা বাড়ি করেছেন। মাসে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতন ভাতা পান। দোকানে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। রমজান মাসে বিক্রি বেড়ে ৯০ হাজার বা সোয়া লাখ টাকা হয়। প্রতি মাসে খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ছয় লাখ টাকা বেতনভাতা দেওয়া হয়। দোকানে ৩২ জন কর্মচারী নিয়মিত কাজ করছেন।
মাসুদ খান জানান, ৩০ বছর আগে পেঁয়াজু, চপ বিক্রি শুরু করেছেন। ফুটপাতেই তার দোকান। তার পেঁয়াজুর বিশেষত্ব হল পেঁয়াজের সঙ্গে সামান্য ময়দা, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা এবং বিশুদ্ধ সয়াবিন তেল। পুরনো তেল দিয়ে কখনও পেঁয়াজু ভাজেন না। পেঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ ভাজার পর তেল অবশিষ্ট থাকলে তা দিয়ে সেদ্ধ ছোলা ভাজেন। পেঁয়াজুর সুনাম প্রথম থেকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি জানান, ৩২ জন পুরুষ নিয়মিত কারিগর ছাড়াও স্বল্পমেয়াদি কিছু নারী কারিগর রয়েছেন। যারা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর কাজ করেন। সবমিলিয়ে প্রতি মাসে তাদেরকে ছয় লাখ টাকা পারিশ্রমিক দেন।
মাসুদ খান আরও বলেন, ‘একটা সময় অনেক কষ্ট করেছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। এই ব্যবসা করে বোনদের বিয়ে দেওয়া, রেস্টুরেন্ট করা, পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছি। মানুষকে তৃপ্তিদায়ক খাবার খাইয়ে নিজেও তৃপ্তির জীবন কাটাচ্ছি।’