মেয়ে খাদিজার চিকিৎসার জন্য ইজিবাইকে যশোরে আসছিলেন মা সোনিয়া খাতুন। সঙ্গে ছিলেন সোনিয়ার আরও দুই ছেলে হাসান-হোসেন, মা মাহিমা, খালা রাহিমা, খালাতো বোন জেবা তাহিরা। কিন্তু হাসপাতালে আসার পথে বেপোরোয়া একটি বাসের চাপায় হারিয়েছেন তার দুই ছেলে, মা, খালা আর খালাতো বোনকে। নিজেও ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন আর খাদিজা যশোর জেনারেল হাসপাতালে।
শনিবার (৮ জুলাই) সকালে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামের বাবুল মুন্সির বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা গেছে, যমজ দুই ছেলের লাশ সামনে নিয়ে নির্বাক বসে আছেন তাদের বাবা হেলাল হোসেন। এই দুই শিশুর পাশের খাটিয়ায় শুয়ে আছেন তাদের নানি মাহিমা বেগম (৪৬)।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বাসচাপায় মারা যান বাবুল মুন্সির স্ত্রী মাহিমা ও তার দুই নাতি হাসান ও হোসেন। যমজ এই দুই ভাইয়ের বয়স দুই বছর এক মাস। একই দুর্ঘটনায় নিহত হন মাহিমা খাতুনের বোন একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামের রাহিমা বেগম মুক্তা (৩২) ও মুক্তার মেয়ে জেবা তাহিরা (৫)। রাহিমার স্বামীর নাম সাইদুল ইসলাম। তিনি মালয়েশিয়া প্রবাসী।
এই দুর্ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ জন ছাড়াও মারা যান ইজিবাইক চালক একই উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে আবু মুসা (১৭) ও আরেক যাত্রী সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের সাইদুল ইসলামের ছেলে ইমরান (২৫)।
শনিবার সকালে নিহত মাহিমার বাড়িতে যেয়ে অভাবনীয় এ দৃশ্য চোখে পড়ে। বাড়ির উঠানে প্রতিবেশীরা ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের ভিড়। কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। আর দুই সন্তানের মৃত্যু, গুরুতর অবস্থায় স্ত্রী ও মেয়ে হাসপাতালে- এসব নিয়ে নির্বাক হেলাল হোসেন।
হেলাল হোসেন বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামেরই বাসিন্দা। তিনি ঢাকার হেমায়েতপুরে একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কারখানায় কর্মরত আছেন। রাতে রওনা দিয়ে ভোরে বাড়ি এসে পৌঁছেছেন। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করেন। কোরবানির ঈদের আগে সবাই গ্রামে এসেছিলেন। ছুটি শেষে হেলাল হোসেন কর্মস্থলে ফিরে গেলেও স্ত্রী সোনিয়া বেগম যমজ সন্তান হাসান- হোসেন ও মেয়ে খাদিজাকে (৫) নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। মেয়ের চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকায় যাননি।
সোনিয়ার চাচা ছোটন হোসেন বলেন, খাদিজার গলায় টিউমার ছিল। এটি অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকালে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি ক্লিনিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে লেবুতলা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে কিছু দূর সামনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের পরিবারের পাঁচ জন মারা যান। এ ছাড়া আমার ভাইঝি সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল রাতেই সোনিয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খাদিজা যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্বজনরা জানান, আজ সকাল ১০টায় যাদবপুর ঈদগাহে তাদের নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
অপরদিকে, একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামে প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বাড়িতেও একই অবস্থা দেখা যায়। আত্মীয়- স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাহিমা বেগম মুক্তা ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা স্বজনদের সঙ্গে যশোরে ক্লিনিকে যাওয়ার পথে মারা যান। তার ভাই সাইদুল ইসলাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ তিনি দেশে এসেছিলেন। সাইদুলের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সুমাইয়া শিরিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে রিফা তামান্না পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জেবা তাহিরা এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়। সকাল ১১ টায় জানাজা শেষে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
গত কালকের দুর্ঘটনার বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে জানিয়ে ওসি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসের চালকও হেলপার এখনও আটক হয়নি।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে যশোর-মাগুরা সড়কের লেবুতলা ব্রিজের কাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে।