খুলনার ডুমুরিয়ার ১৮ মাইল এলাকা থেকে কয়রা উপজেলা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৩৯ কোটি টাকা। দেড় বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় পার হয়ে আরও এক বছর তিন মাস চলে গেলো। অথচ এখন পর্যন্ত কাজও শেষ হয়নি।
চুক্তি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে দেখিয়ে ৯০ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে দুই দফায় কাজের মেয়াদ বাড়িয়েছে তারা। প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়েছে আরও ৯৫ কোটি টাকা।
পাশাপাশি একই সড়কের ৩৪টি বাঁক সোজা করতে জমি অধিগ্রহণের জন্য ৭২ কোটি টাকা পৃথক রবাদ্দ দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। এর মধ্যে ১৮ ফুট সড়কটি ২৪ ফুট প্রশস্ত করার কথা রয়েছে। এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রকল্প হিসেবে কয়রা সদর থেকে মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত তিন কিলোমিটারের উন্নয়ন এবং বেতগ্রাম থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত প্রশস্তকরণের কাজের দুটি প্যাকেজ করেছে সওজ। এজন্য ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ৩৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় আড়াই বছরে বেড়েছে আরও ২৬২ কোটি।
এদিকে, দফায় দফায় ব্যয় ও সময় বাড়ানোর পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সওজ ঠিকমতো কাজ করছে না বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে থাকায় লক্ষাধিক মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডুমুরিয়ার ১৮ মাইল এলাকা থেকে কয়রা উপজেলা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি। দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজকে ৩৩৯ কোটির প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ করার কথা ছিল তাদের। ইতোমধ্যে দুই দফায় কাজের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়িয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রথমবার বরাদ্দ বাড়ানো হয় ৪০ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে প্রকল্পের কাজের মধ্য থেকে তিন কিলোমিটার অংশ আলাদা করা হয়। এর জন্য দ্বিতীয়বার ব্যয় ধরা হয় আরও ৫৫ কোটি টাকা। কাজের পরিধি এবং নির্মাণসামগ্রীর দামের সঙ্গে সমন্বয় করে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। ২০২৪ সালের ৩০ জুন কাজ শেষের কথা বলা হয়। ইতোমধ্যে কাজের ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে ৯০ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে তারা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬৫ কিলোমিটারের মধ্যে ২০ কিলোমিটারের ৩০টি স্থানে এখন পর্যন্ত কোনও কাজ করা হয়নি। পুরো সড়কের ৩৪টি পয়েন্টের বাঁক সোজা করা হয়নি। দুই পাশে গাইডওয়াল ও প্যালাসাইডিংয়ের মাটি ভরাট করা হয়নি। ফলে সড়কের এসব স্থানের অবস্থা বেহাল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেতগ্রাম থেকে তালাবাজার হয়ে পাইকগাছার মৌখালি পর্যন্ত তিন কিলোমিটার পরপর কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে। ১৪টি স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ১২ কিলোমিটার সড়ক বেহাল। কয়রা উপজেলা অংশে তিন কিলোমিটার এবং কয়রা সদর থেকে দেয়াড়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের কাজ অসম্পূর্ণ। যেসব স্থানে গাইডওয়াল ও প্যালাসাইডিং করা হয়েছে, সেখানেও মাটি ভরাট করা হয়নি। ফলে কয়রা থেকে বেতগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, পৃথক অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও সড়কের ৩৪টি বাঁক সোজা করতে জমি অধিগ্রহণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। জমি অধিগ্রহণের জন্য সার্ভে করা হলেও জটিলতা দেখা দেয়। সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কের বাঁক সোজা করতে ৭২ কোটি টাকা পৃথক রবাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৮ ফুট সড়কটির ২৪ ফুট প্রশস্ত করার পরিকল্পনা যুক্ত হয়েছে। ফলে কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে।
এ বিষয়ে সওজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আজিম কাওছার বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে সড়কের ৩৪টি বাঁক সোজা করার কাজ এখনও বাকি আছে। ওসব স্থানের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার খুঁড়ে রাখা হয়েছে। দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘সংযুক্ত প্রকল্প হিসেবে কয়রা সদর থেকে মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত তিন কিলোমিটারের উন্নয়ন এবং বেতগ্রাম থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত প্রশস্তকরণের কাজের দুটি প্যাকেজ করেছে সওজ। এজন্য ৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
জমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে জানিয়ে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘প্রকল্পের ৩৪টি বাঁকের কিছু অংশের কাজ বাকি আছে। জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বৈদ্যুতিক খুঁটি সরানোসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি, এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
কবে নাগাদ কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বরত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খোকন বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন কিছু কাজ বাকি আছে, তা বর্ষার জন্য করা যাচ্ছে না। এখনও আমরা পুরো অর্থ পাইনি, পেলে বাকি কাজ করে দেবো।’
দুর্ভোগের কথা জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি মোস্তফা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কয়রা থেকে খুলনা যাওয়ার একমাত্র সড়কের বেহাল দশা। গত পাঁচ বছর ধরে চরম ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করছি। সড়কের দুই-তিন কিলোমিটার পরপর ভাঙাচোরা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ৬৫ কিলোমিটার সড়কের অর্ধেক কাজ বাকি। কাজ নিয়ে গড়িমসি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।’
সড়কের এই দুর্ভোগ কবে শেষ হবে, তা জানা নেই উল্লেখ করে পাইকগাছা নাগরিক কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সড়কের বাঁকে বাঁকে দুর্ভোগ। জমি অধিগ্রহণের দোহাই দিয়ে কাজ ফেলে রাখা হয়েছে। এতে একদিকে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হচ্ছে অন্যদিকে মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’