দ্বিগুণ দামে কালোবাজারে লঞ্চের কেবিন, ‌কিছুই করার নেই বললেন বন্দরের উপপরিচালক
বাংলাদেশ

দ্বিগুণ দামে কালোবাজারে লঞ্চের কেবিন, ‌কিছুই করার নেই বললেন বন্দরের উপপরিচালক

ঢাকা থেকে বরিশালে আসার পর আবার ঢাকায় যাবেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা অপু আলী। গত সোমবার জানতে পারেন পারাবত কোম্পানির দুটি লঞ্চ যাবে। কাউন্টারের নম্বরে কল করে ডাবল কেবিন চাইলে বলা হয়, ঘাটে আসেন। ঘাটে গিয়ে বুকিং কাউন্টারে গেলে জানানো হয়, টিকিট নেই। সেখান থেকে বের হয়ে নৌবন্দরের ঘাটে দাঁড়ানোর পরই একজন এসে জিজ্ঞাসা করেন, ‘টিকিট লাগবে? ডাবল নাকি সিঙ্গেল? ডাবল তিন হাজার এবং সিঙ্গেল এক হাজার ৫০০ টাকা।’ এরপর বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও টিকিট না পেয়ে ওই কালোবাজারির কাছ থেকে তিন হাজার টাকায় টিকিট কিনে ঢাকায় যান অপু।

শুধু অপু নন, বরিশাল-ঢাকা নৌপথে লঞ্চের টিকিট পেতে প্রতিদিন এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এটি এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালোবাজারি চক্রের দৌরাত্ম্যে লঞ্চের কেবিন যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। এতে ভোগান্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে যাত্রীদের। গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী-সংকটে এই নৌপথে লঞ্চ কমানোর উদ্যোগ নেয় লঞ্চমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থা। প্রতিদিন চারটি লঞ্চের স্থলে সিন্ডিকেট করে প্রথমে তিনটি ও পরে দুটি লঞ্চ চলাচলের উদ্যোগ নেয়। এতে যাত্রীদের মধ্যে কেবিনের চাহিদা বাড়ে। এ সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে টিকিট কালোবাজারি চক্র। বর্তমানে এই চক্রের কাছে জিম্মি লঞ্চের হাজার হাজার যাত্রী। 

যাত্রীরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন বরিশাল থেকে সাতটি ও ঢাকা থেকে ছয়টি লঞ্চ চলাচল করতো, সেখানে এখন চলছে দুটি করে চারটি। লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে লঞ্চ চালাচ্ছেন মালিকরা। ফলে কালোবাজার ছাড়া টিকিট পাওয়া যায় না। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে।

যাত্রীদের অভিযোগ, কালোবাজারি চক্র ঢাকা ও বরিশাল দুই প্রান্তে আগে-ভাগে সব টিকিট বুকিং করে রাখে। লঞ্চ ছাড়ার দিন কিংবা আগের দিন বুকিং অফিসে গিয়ে টিকিট পাওয়া যায় না। সরাসরি লঞ্চে গেলেও কর্মচারীরা টিকিট নেই বলে যাত্রীদের ফিরিয়ে দেন। কিন্তু কালোবাজারে সেই টিকিট দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে পাওয়া যায়। শুধু কেবিন নয়; ডেকে তোশক বিছিয়ে যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আদায় করছে চক্রটি। কালোবাজারি সিন্ডিকেটের এমন দৌরাত্ম্য শুরু হয় গত বছরের নভেম্বর থেকে। এখন চক্রটি আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। লঞ্চ কোম্পানির কর্মকর্তারা কালোবাজারিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে টিকিট বিক্রি করছেন। টিকিট কালোবাজারে প্রথম সারিতে রয়েছে পারাবত লঞ্চ কোম্পানি। 

রোটেশন পদ্ধতিতে জিম্মি যাত্রীরা

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় লঞ্চের যাত্রী কিছুটা কমেছে। তারপরও বরিশাল-ঢাকা নৌপথে চারটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করতো। বর্তমানে লঞ্চ মালিকরা সমন্বয় করে রোটেশন পদ্ধতিতে প্রতিদিন দুটি লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে করে দুটি লঞ্চই সিন্ডিকেট করে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে। লঞ্চের পরিমাণ বেশি থাকলে এই সমস্যা হতো না। এর ফলে জিম্মি হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা।

কাউন্টারগুলো গুটিয়ে নেওয়ায় ভোগান্তি যাত্রীদের

বরিশালে লঞ্চের টিকিট বুকিং কাউন্টারগুলো গুটিয়ে নিয়েছেন প্রায় সব কোম্পানি। ফলে টিকিট পেতে ভোগান্তির শেষ নেই যাত্রীদের। নৌবন্দরে লঞ্চ আসার পর সেখানে গিয়ে টিকিট পাওয়ার কথা ছিল। অথচ সেখানে কোনও টিকিট পান না যাত্রীরা। বেলা শেষে কালোবাজারিদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হয়। 

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা অপু আলী বলেন, ‘ঢাকায় যেতে পারাবত লঞ্চে একটি ডাবল কেবিনের জন্য দুদিন ধরে ঘুরেও টিকিট পাননি। শেষে তিন হাজার টাকায় টিকিট কিনে ঢাকায় এসেছি। এটি যাত্রীদের জন্য ভোগান্তি।’ 

নগরের বাসিন্দা শোয়াইব সাকির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর সিন্ডিকেট করে লঞ্চ কমিয়ে দিয়েছেন মালিকরা। সেইসঙ্গে সব টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন তারা। এতে জিম্মি হয়ে পড়েছি আমরা। দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনে যাতায়াত করতে হয়। জেলা প্রশাসন ও নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ জেনেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। লঞ্চ বাড়িয়ে রোটেশন পদ্ধতি বাতিল করলে এই জিম্মি দশা থেকে রেহাই পাবো আমরা।’ 

যেভাবে কালোবাজারে যাচ্ছে টিকিট

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালোবাজারে টিকিট বিক্রির সঙ্গে জড়িত এক দালাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা লঞ্চ কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের ম্যানেজ করে আগেই বেশিরভাগ টিকিট কেটে রাখি। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ডাবল কেবিনের টিকিটে ৩০০ এবং সিঙ্গেলে ২০০ টাকা বেশি দিয়ে কাটতে হয়। বিশেষ করে ছুটি কিংবা কোনও উৎসবে যাত্রীদের চাপ বাড়লে ব্যবস্থাপকদের আরও ১০০-২০০ টাকা বেশি দিতে হয়। বরিশাল ও ঢাকা উভয় প্রান্তের টিকিট আমাদের কাছে থাকে সবসময়। এখানে একটা সুবিধা আমাদের দেওয়া হয়, তা হলো যদি কোনও টিকিট দালালরা বিক্রি করতে না পারে, সেটির টাকা ফেরত দেওয়া হয়। তবে অতিরিক্ত যে ৩০০ ও ২০০ টাকা বেশি দিই আমরা, সেটি ফেরত দেওয়া হয় না। তবু আমাদের লোকসান হয় না, কারণ আমরা বেশি দামেই টিকিট বিক্রি করি। চার-পাঁচটি বিক্রি করতে পারলে এক হাজার টাকার বেশি লাভ হয়।’

টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে ১৫-২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত উল্লেখ করে চক্রের এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কেউ লঞ্চের কাউন্টারের প্রতিনিধি, আবার কেউ বন্দরে চা-পান ও ডিমসহ বিভিন্ন খাবার বিক্রি করেন। এ ছাড়া লঞ্চের কেবিনবয় থেকে শুরু করে চালক পর্যন্ত চক্রের সঙ্গে জড়িত। বাড়তি উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে এই কাজ করছেন সবাই। আমাদের টার্গেট থাকে দিনে অন্তত পাঁচটি টিকিট বিক্রির। লঞ্চ স্টাফদের টার্গেট থাকে একটি কিংবা দুটি। ভাড়া নেওয়া হয় মৌসুম ও যাত্রীর চাপ দেখে। যাত্রী বেশি দেখলে ডাবল কেবিনে তিন হাজার এবং সিঙ্গেলে এক হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। মানামী ও পারাবত লঞ্চ থেকে বেশি টিকিট পাই আমরা। ওই দুটি লঞ্চ যেদিন বরিশাল থেকে যায় সেদিন আমাদের আয় বেশি হয়। ওই লঞ্চের প্রতিনিধিরাই কল করে আমাদের টিকিট দেন। কেবিন থাকলেও যাত্রীরা লঞ্চে গেলে বলে দেওয়া হয় টিকিট নেই। বাধ্য হয়ে যাত্রীদের কালোবাজার থেকেই টিকিট কিনতে হয়।’ 

বিআইডব্লিউটিএ বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পূর্বে ডেকের ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। পরে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে ৪৫৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি ডাবল কেবিনের ভাড়া দুই হাজার ও সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 

যা বলছেন লঞ্চের ব্যবস্থাপকরা

কালোবাজারে টিকিট বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে মানামী লঞ্চের ব্যবস্থাপক মো. মঞ্জু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দালালরা অনলাইনের মাধ্যমে টিকিট কিনে সেগুলো কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করছেন। কালোবাজারে টিকিট বিক্রির সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।’

সুন্দরবন নেভিগেশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার জানামতে বেশিরভাগ টিকিট কালোবাজারে যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। আমার কাছ থেকে কালোবাজারে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে অন্য লঞ্চগুলো কে কী করছে, তা আমার জানা নেই। আমরা অনলাইনে নজরদারি বৃদ্ধির দাবি জানাই।’ 

অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন আহমেদ বলেন, ‘কেবিন ও সোফার টিকিট দিয়ে লঞ্চের আয় হয় না। লঞ্চের ডেক পরিপূর্ণ হলেই তবে আয় হয়। তেলের দাম বাড়ার কারণে লঞ্চের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তার ওপর সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে লঞ্চ ব্যবসা বন্ধের উপক্রম করেছে।’

লঞ্চ মালিক সমিতির সদস্য ও সুরভী নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন উল কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডেক তো পরিপূর্ণ হচ্ছে না, যে কারণে রোটেশন তুলে নেওয়া যাচ্ছে না। তবে আরেকটি লঞ্চ রোটেশনে যুক্ত করা যায় কিনা সে ব্যাপারে সমিতিতে আলোচনা করবো। কেবিন ও সোফার টিকিট কালোবাজারে যাওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমাদের লঞ্চের টিকিট যাতে কালোবাজারে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখছি।’

কেবিনের টিকিট পেতে প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের

গত সোমবার সন্ধ্যায় নদীবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে পারাবত লঞ্চ। এটির ডেকে তোশক বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কর্মচারীরা প্রতিজনের ৩০০ টাকা ভাড়াসহ তোশক ৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন। অনেক যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে বসার স্থান পাচ্ছিলেন না। 

এই লঞ্চের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘লঞ্চের ডেকে অনেক জায়গা থাকে। আমরা তোশক বিছিয়ে আলাদা আয় করি। যাত্রীরা খুশি হয়ে আমাদের কাছ থেকে তোশক ভাড়া নেন।’

কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন

বরিশাল নদীবন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লঞ্চের টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে এটা ঠিক, তবে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। আগাম টিকিট বুকিং যে হচ্ছে, তাও সত্য। কিন্তু কারা কিনছে, তা খতিয়ে দেখা কঠিন। তবে রোটেশন তুলে না নিলেও বরিশাল-ঢাকা নৌপথে দিনে আরও দুটি লঞ্চের প্রয়োজন। কারণ প্রচুর যাত্রী।’

বরিশাল নৌবন্দরের উপপরিচালক শেখ মোহাম্মদ সেলিম রেজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লঞ্চের কেবিনের টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে নৌঘাটে অভিযান পরিচালনার অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবো। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীর চাপ আছে। তারপরও লঞ্চ মালিক সমিতি কেন রোটেশন পরিবর্তন করছে না, তা আমি জানি না। এটি আসলে লঞ্চ মালিকপক্ষের সিদ্ধান্ত, আমাদের কিছুই করার নেই।’

Source link

Related posts

অনলাইনে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটার নিয়ম

News Desk

বরিশালে লঞ্চগুলোতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই

News Desk

দ্রুত শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত

News Desk

Leave a Comment