জাটকা রক্ষায় দুই মাসের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে আবারও ইলিশ শিকারে নদীতে নেমেছেন জেলেরা। তবে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছের দেখা। নদী থেকে খালি হাতে ফিরেছেন তারা। এ অবস্থায় ইলিশের মোকাম বরিশাল নগরীর পোর্টরোডে ইলিশ নেই বললেই চলে। যা আছে তা দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
মৌসুমের এই সময়টাতে উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ার কথা প্রচুর। কিন্তু জেলেরা নদ-নদীতে জাল ফেললেও তেমন ইলিশ উঠছে না। যা কিছু জাটকা উঠছে, সেগুলোর দাম অনেক বেশি।
এ বিষয়ে জেলার মৎস্য কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন মূলত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসকে ইলিশের মূল মৌসুম ধরা হয়। এখন মে-জুন-জুলাইকে ‘ডাল সিজন’ মনে করা হয়। তাই মাছ না পাওয়ায় হতাশার কিছু নেই। সামনে পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে প্রজনন, উৎপাদনে হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত, পানির চাপ—এর সঙ্গে প্রজনন-উৎপাদন সম্পর্কিত।
বরিশাল আবহাওয়া বিভাগের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে বরিশাল অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস ছিল বৃষ্টিবিহীন। মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলেও এপ্রিলে আবার তা অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। সামনে বৃষ্টি হলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
গত বুধবার (১ এপ্রিল) মধ্যরাত থেকে নদ-নদীতে ইলিশ শিকারে নামেন জেলার অর্ধলক্ষাধিক জেলে। তারা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরতে নদীতে গিয়েছিলাম। যেমন আশা করেছিলাম তেমন মাছ পাচ্ছি না। যে কয়েকটা মাছ পেয়েছি, তাতে ট্রলারের তেলের খরচই উঠবে না।
পোর্টরোডে বুধবার সকালে ইলিশ কিনতে যান নগরীর কালিবাড়ি রোডের বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা রনি হোসেন। হতাশ হয়ে ফিরেছেন বাসায়। কারণ বাজারে যে কয়েকটি ইলিশ দেখেছেন, সেগুলোর দাম শুনে অবাক তিনি। এর মধ্যে এক কেজি ৯০০ গ্রামের একটি ইলিশের দাম চাওয়া হয়েছে সাত হাজার টাকা। হিসাবে মণ দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকা। এই প্রতিবেদক পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
এই সময়ে পোর্টরোডের মোকাম ইলিশে ভরপুর থাকার কথা উল্লেখ করে রনি বলেন, ‘প্রতিবার নিষেধাজ্ঞা শেষের পর ইলিশ মোকাম পরিপূর্ণ থাকে। এজন্য আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম পরদিন যাবো। কিন্তু বাজারে গিয়ে হতাশ হলাম। মোকাম ইলিশশূন্য। যে কয়েকটি ইলিশ এসেছে, তার যা দাম চাওয়া হয়েছে তা কারও কেনার সাধ্য আছে বলে মনে হয় না। আমার বয়সে এত দাম দেখিনি। এভাবে হলে মাছ কেনা যাবে না। কম দামে কেনার আশায় এসেছিলাম। কিন্তু কেনা সম্ভব হয়নি। আমার মতো অনেকে না কিনে ফিরেছেন।’
এদিন ১০ কেজি ইলিশ নিয়ে মোকামে আসা জেলে আনোয়ার খোকন বলেন, ‘সাত-আট জন মিলে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। কিছু ইলিশ পেলেও আকারে ছোট। একবার জাল ফেলে তিন ঘণ্টা পর তুললেই ইলিশ পেতাম প্রচুর। কিন্তু এবার ছয়-সাত ঘণ্টা জাল ফেলে রেখেও পাইনি। রাত ১২টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত দুবার জাল ফেলে কিছু পেয়েছি। এতে জেলে এবং ট্রলারের তেল খরচই উঠবে না।’
আরেক জেলে জাকির হোসেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার দুই মাস ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছি। ভেবেছিলাম নিষেধাজ্ঞা শেষে শোধ করবো। কিন্তু নদীতে মাছ পাইনি। কীভাবে ধারদেনা শোধ করবো চিন্তায় আছি।’
পোর্টরোডের মোকামে কর্মরত শাহজাহান ও জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার পর এভাবে ইলিশশূন্য মোকাম কোনোদিন দেখিনি। প্রতিবার নিষেধাজ্ঞা শেষে ভোররাত থেকে বিভিন্ন স্থানের ইলিশবোঝাই ট্রলার আসতো। মণকে মণ মাছ থাকতো। গত দুদিনে তেমন ইলিশ আসেনি। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার পর থেকে কিছু এসেছিল। দুদিনে ৫০ মণও আসেনি। এতে আমরা বেকার বসে আছি।’
পোর্টরোড মোকামের আড়তদার জহির সিকদার বলেন, ‘গত বছরও এই সময়ে দিনে ৫০০ মণ ইলিশ এসেছিল। সেখানে এখন দিনে ৪০ মণও আসছে না। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ইলিশ শিকার করেছিলেন জেলেরা। এজন্য এবার বোধহয় উৎপাদন বাড়েনি। এছাড়া নিষেধাজ্ঞার আগে এবং চলাকালীন ব্যাপক হারে জাটকা শিকার হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। এজন্য কম।’
দাম দ্বিগুণ উল্লেখ করে জহির সিকদার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে দুই কেজির ইলিশের মণ দেড় লাখ, দেড় কেজির মণ এক লাখ, এক কেজির মণ ৮০ হাজার, এলসি সাইজের মণ ৬৫ হাজার, ভেলকার মণ ৫২ হাজার এবং ছোট ইলিশের মণ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা গত মৌসুমের দামের চেয়ে দ্বিগুণ।’
মোকামের আরেক আড়তদার রবীন রায় চৌধুরী বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ইলিশ ব্যবসায় জড়িত। এবার মোকামে ইলিশ নেই বললেই চলে। সংকটের প্রধান কারণ জাটকা শিকার। নিষেধাজ্ঞার আগেই প্রচুর জাটকা নিধন হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময়েও বাজারে প্রচুর জাটকা এসেছিল। জাটকা নিধন বন্ধ করা না গেলে সামনে সংকট আরও বাড়বে।’
আগে বিভাগের ছয় জেলায় হাতেগোনা কয়েকটি আড়ত ছিল জানিয়ে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে বিভাগের বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক মোকামে ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে। অনেকে আবার সরাসরি ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। এই কারণেও এই মোকামে ইলিশ কম আসছে।’
নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণ জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘গত বছর আর এ বছরের মধ্যে বিশাল ব্যবধান আছে। কারণ গত বছর এত তাপমাত্রা ছিল না। এবার অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ইলিশ কম ধরা পড়ছে। এর সঙ্গে বৃষ্টি এবং জোয়ার-ভাটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
নিষেধাজ্ঞা সফলভাবে পালন হয়নি জেলে ও ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত বৃষ্টি না হওয়ায় ইলিশ ধরা পড়ছে না। তবে নিষেধাজ্ঞা শতভাগ সফল না হলেও এবার আগের চেয়ে বেশি অভিযান চালানো হয়েছে। উৎপাদন কমেছে এই কথা এখনও বলা ঠিক হবে না। কারণ নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে মাত্র দুদিন আগে। অনেক জেলে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে গেছেন। তারা এখনও ফিরে আসেননি। তারা এলে বোঝা যাবে। তবে বৃষ্টিপাত শুরু হলে মাছ ধরা পড়ার পরিমাণ বাড়বে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ আগের মৌসুমগুলোতেও বৃষ্টিপাতের সময় বেশি ধরা পড়েছিল।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ হবে কিনা জানতে চাইলে রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘লক্ষ্যামাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করছি। ছোট ইলিশ বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতেই দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচ অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে ইলিশ বড় হয়ে গেছে। সময়মতো ঠিকই ধরা পড়বে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইলিশ রক্ষায় প্রতি বছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকার। এই সময়ে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০০৬ সাল থেকে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস বিস্তীর্ণ নদ-নদীর সীমাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। অভয়াশ্রমের সীমানার মধ্যে ছিল ইলিশার মদনপুর থেকে ভোলার চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহাবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার। ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার। চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার এবং শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার। বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদীর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাট পয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট, হিজলার মৌলভীরহাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার এলাকা।