নদ থেকে অবৈধভাবে তোলা বালুতে পৌরসভার চত্বর তৈরি করছেন প্যানেল মেয়র
বাংলাদেশ

নদ থেকে অবৈধভাবে তোলা বালুতে পৌরসভার চত্বর তৈরি করছেন প্যানেল মেয়র

আইনে নিষেধ থাকলেও রাতের আঁধারে হরিহর নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ভরাটের কাজ চলছে যশোরের মণিরামপুর পৌরসভার নির্মাণাধীন ভবন চত্বর। নদের বালু দিয়ে তারই পাশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের বালু ভরাটের কাজও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। 

স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় ৩০০ ট্রাক বালু উত্তোলন করা হয়েছে এই নদ থেকে। ফলে নদের পাড় রয়েছে ভাঙনের ঝুঁকিতে। বালু উত্তোলনের জায়গা থেকে খুব কাছেই উপজেলা ভূমি অফিস। সেখানকার কর্মকর্তাদের কয়েক দফা জানিয়েও সুফল পাননি স্থানীয় লোকজন।

পৌরসভা ভবনের সামনে বালু ভরাট আর স্কুল নির্মাণের সব কাজ করছেন মণিরামপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ কামরুজ্জামান। কিন্তু মণিরামপুর পৌরসভার মেয়র কাজী মাহমুদুল হাসান কিংবা প্রভাতী বিদ্যাপীঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিএম মাকসুদুর রহমান জানেন না বালু আসছে কোথা থেকে। অবশ্য মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেছেন, অভিযোগ পাওয়ার পরপরই বালু উত্তোলনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) মণিরামপুর পৌরসভা ও পাশের সরকারি প্রভাতী বিদ্যাপীঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন দুটি ভবনের ভূমি ভরাটের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এই দুটি ভবনের অদূরে হরিহর নদ থেকে পাইপের মাধ্যমে। নদের মাঝে দুটি শ্যালো মেশিন বন্ধ অবস্থায় রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাত ৮-৯টার দিকে শ্যালো মেশিন চালু হয়, চলে ভোর পর্যন্ত। শ্যালো মেশিনের শব্দে রাতে ঘুমাতে পারেন না তারা। কিন্তু মুখ খোলার সাহস নেই তাদের। বালু তুলতে হরিহর নদ থেকে মণিরামপুর পৌরসভা পর্যন্ত জোড়া দেওয়া রয়েছে পাইপ। স্কুলের ভীত ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

হরিহর নদ পাড়ে ৩ নম্বর ওয়ার্ড দুর্গাপুর ও উল্টো পাশে ৫ নম্বর ওয়ার্ড তাহেরপুরের বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ভোর পর্যন্ত দুটি শ্যালো মেশিন চালিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। দিনে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। ক্ষতির সম্মুখীন হলেও বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না তারা।

গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হরিহর নদ থেকে বালু তোলার জন্য প্যানেল মেয়র কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে দুটি শ্যালো মেশিন বসানো হয়। তাহেরপুর এলাকার রবিউল ইসলাম নামের এক যুবক বালু তোলার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, মণিরামপুর পৌরসভার নবনির্মিত ভবনের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের প্রথম দিকে। চলতি বছরের ১২ নভেম্বর নতুন পৌর ভবনের দুটি কক্ষ উদ্বোধন করা হয়েছে। বর্তমানে ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। ৭৯ শতক জমির ওপর ভবনটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ৮২ লাখ টাকা। বনান্তর জেভি ও মেসার্স মঈনুদ্দিন বাঁশী নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার পেলেও নির্মাণকাজ করছেন প্যানেল মেয়র-১ কামরুজ্জামান।

অপরদিকে, প্রভাতী বিদ্যাপীঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন তিনতলা ভবনটি প্রায় চার শতাংশ জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কাজ পেয়েছেন মণিরামপুরের দেলোয়ার হোসেন। তিনি প্যানেল মেয়র কামরুজ্জামানের স্বজন এবং কাজটি তিনিই করছেন। এক কোটি ২৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে চলতি বছরের নভেম্বরে কাজ শুরু হয়। আগামী জুন মাসে কাজ হস্তান্তরের কথা বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক অভিযোগ করেছেন, নদের পাড়ে তার দোতলা বাড়ি। যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে, তাতে যেকোনো সময় বাড়িঘর ধসে নদীতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বালু তোলা বন্ধ করতে তারা ১০-১২ জন গণদরখাস্ত করে ইউএনও, এসিল্যান্ড, পৌর কর্তৃপক্ষ এবং মণিরামপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। দরখাস্ত দেওয়ার পরদিন রাতে ফোন করেন এসিল্যান্ডকে। কিন্তু তাতেও বালু তোলা বন্ধ হয়নি।

দুর্গাপুর এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, আশপাশের ৫০ ঘরের বাসিন্দা তাদের বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। ভবন মালিকরা আরও ঝুঁকিতে। এভাবে আর এক সপ্তাহ চলতে থাকলে বাড়িঘর নদে চলে যাবে। পাশে ভূমি অফিস হলেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। প্রতিদিন রাতের আঁধারে বিকট শব্দে মেশিন চালানো হয়। বয়স্ক এবং শিশুরা মেশিনের শব্দে ঘুমাতে পারে না।

নির্মাণাধীন ভবনের ভরাটের কাজ প্রায় সম্পন্ন

বালু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত তাহেরপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চার জন শ্রমিক কাজ করছি। দুটি শ্যালো মেশিন দিয়ে তিন দিন পৌরসভার মাঠে ২৫-৩০ ট্রাক বালু তুলেছি। প্রাইমারি স্কুলে ৩০ ট্রাক তোলা হয়েছে। রাতেই বালু তোলা হয়। দিনে শ্যালো মেশিন বন্ধ রাখা হয়।’

এ বিষয়ে জানতে প্যানেল মেয়র-১ কামরুজ্জামানকে একাধিকবার ফোন দিলেও গত দুই দিনে কল রিসিভ করেননি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফোন দিলে কল রিসিভ করে বলেন, ‘বালু তোলা বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।’

নদ থেকে কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন বালু তোলা বন্ধ। এ বিষয়ে আর কোনও কথা থাকতে পারে না।’

নদ থেকে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে মণিরামপুর পৌরসভার মেয়র কাজী মাহমুদুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাটি দিয়ে ভরাট করার কথা পৌরসভার চত্বর।’

কিন্তু নদ থেকে পাইপের মাধ্যমে বালু এনে ভরাট কাজ হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। প্রকৌশলী এ ব্যাপারে বলতে পারবেন।’

মণিরামপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) উত্তম মজুমদার বলেন, ‘নদ থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমি জানি না। এটা আমার কাজও না। মণিরামপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ কামরুজ্জামান ভবনের সামনের অংশ বালু ভরাট করছেন। এসব বিষয়ে উনি আর ঠিকাদার বলতে পারবেন।’

জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলী হাসান বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে বালু তোলার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

১৫ দিন আগে স্থানীয়রা দরখাস্ত দেওয়ার পর বন্ধ করতে এতদিন কেন লাগলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দরখাস্ত পাওয়ার পর আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে পাইনি।’

মণিরামপুর পৌরসভার নির্মাণাধীন ভবন চত্বর

দরখাস্তকারীরা একদিন পর রাতে আপনাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান বলে দাবি করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সে রাতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কাউকে পায়নি তারা।’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) আলী হোসেন বলেন, ‘বালু উত্তোলনকারীরা গভীর রাতে কাজ করতো। রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর জন্য পেশকার, পুলিশ ও গাড়িচালক ছিলেন না। সে কারণে প্রথমদিকে অভিযান চালানো যায়নি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘তিন-চার দিন আগে দরখাস্ত পেয়েই অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় এসিল্যান্ডকে। ইতোমধ্যে অনুমতিবিহীন বালু উত্তোলনের কাজ বন্ধ করা হয়েছে।’

নদী থেকে বালু কিংবা মাটি তোলার বিষয়ে যা বলা আছে আইনে

ভূ-গর্ভস্থ কিংবা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন সংক্রান্ত বিশেষ আইনের ৫-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনও মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। (২) নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণ সাপেক্ষে, সুইং করিয়া নদীর তলদেশ সুষম স্তরে (River Bed Uniform Level) খনন করা যায়; এই রূপ ড্রেজার ব্যবহার করে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। (৩)-এর উপ-ধারা (২)-এর অধীন ড্রেজিং কার্যক্রমে বাল্কহেড বা প্রচলিত বলগেট ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না।

Source link

Related posts

গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কমেছে

News Desk

পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে, কাল থেকে রোজা শুরু

News Desk

৫ দিন ধরে পানিবন্দি সুনামগঞ্জের মানুষ, ত্রাণ পায়নি অনেক পরিবার

News Desk

Leave a Comment