নুরুন্নাহার বেগম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ভীষণ খ্যাতি। উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ সুনাম কুড়োনো এ নারী পেয়েছেন জাতীয় কৃষি পুরস্কার, পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাংকের সম্মাননা-পদকও। কিন্তু ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’ যে থাকে, সে কথা সত্য যেন নুরুন্নাহারের বেলায়ও। প্রচারের আলোয় নুরুন্নাহার নিজেকে ‘সফল খামারি’ বলে প্রতিষ্ঠিত করলেও সরেজমিনে পাওয়া তথ্য বলছে, অন্যের গরু নিজের খামারে এনে ছবি তুলে তা ব্যবহার করছেন এই নারী। সেই ছবি দেখিয়ে এবং অসত্য তথ্য দিয়ে সরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের টাকা ঋণ নিয়েছেন। নিজের মাত্র ২৯ বিঘা জমি থাকলেও বর্গাসহ ১৬০ বিঘা জমিতে ‘নুরুন্নাহার কৃষি খামার’ আছে উল্লেখ করে তিনি আবেদন করেছেন ২৬ কোটি টাকার ঋণের জন্য। সেই ঋণ নুরুন্নাহারকে দেয়ার জন্য ১৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা মঞ্জুরও করে ফেলেছে অগ্রণী ব্যাংক।
পাবনার ঈশ্বরদীর জয়নগরের বক্তারপুর গ্রামের নুরুন্নাহার বেগমের প্রতিষ্ঠান ‘নুরুন্নাহার কৃষি খামার’ অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকার মতিঝিলের প্রধান শাখার গ্রাহক। এখান থেকেই ২০২০ সালে নেয়া ঋণ অপরিশোধিত থাকা সত্ত্বেও নতুন ওই ঋণের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। তার ঋণ আবেদন মঞ্জুরও হয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাসে। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ। যদিও নুরুন্নাহার আগের ঋণ শোধ করেছেন দাবি করে বলছেন, তার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নুরুন্নাহার ২০২০ সালে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক থেকে, যা নিয়ম মেনে দেয়া হয়নি। সে দায়-দেনা থেকে গেলেও তিনি নতুন করে ২৬ কোটি ৯১ লাখ টাকার প্রকল্প ব্যয়ের বিপরীতে ৬০:৪০ ঋণ ও ইকুইটি অনুপাতে নয় মাস বাস্তবায়ন ও তিন মাস রেয়াতী সময়সহ আট বছর মেয়াদে ১৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা প্রকল্প ঋণ চেয়েছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা মেয়াদী ঋণ এবং এক কোটি ৭৯ লাখ চলতি মূলধন ঋণ। এ আবেদন মঞ্জুরও করেছে অগ্রণী ব্যাংক। ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ শতাংশ।
প্রায় শূন্য নুরুন্নাহারের কৃষি খামার, এই খামারকেই ভিত্তি করে পৌনে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছেন তিনি ঋণ আবেদনে তিনি বলেছেন, বর্গাসহ ১৬০ বিঘা জমির ওপর তার কৃষি খামার আছে। সেখানে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, ঘি, মাখন, পনির, জ্যাম-জেলি, আচার উৎপাদন ও কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করবেন।
যদিও তার আবেদনের তথ্যের সঙ্গে সরেজমিনে পাওয়া তথ্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। দাশুড়িয়া-পাকশী রোডের জয়নগর তিন মাথার মোড় থেকে দুই কিলোমিটার পথ গেলেই বক্তারপুরে যেখানে নুরুন্নাহারের কথিত কৃষি খামার আছে বলে প্রচার, সেখানে খামারের স্থাপনা থাকলেও চাষবাসের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। কয়েকটি ভাঙাচোরা প্লাস্টিকের পানির পাত্র ছাড়া কিছু নেই সেখানে। নুরুন্নাহার প্রতিদিন কয়েকশ’ লিটার দুধ বিক্রি করেন বলে প্রচার চালালেও তার খামারে বাছুরসহ মাত্র ছয়টি গরু দেখা যায়। বিভিন্ন সময় ওই খামারে মুরগির সঙ্গে তার তোলা ছবি প্রচার হলেও সেখানে গিয়ে এমন কিছু দেখা যায়নি। মুরগির বদলে পাশের ক্ষেতে পেয়ারা, সবজি, আম, লিচু, ড্রাগনের বাগান দেখা যায়। সেই ক্ষেতেই কাজ করেন তার দুজন কর্মচারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, ছোট একটি পুকুরকে নিজের খামারের অংশ বলে প্রচার করেন নুরুন্নাহার। বিভিন্ন ব্যক্তির খামারে বা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের খামার বা ক্ষেত বলে প্রচার করেন তিনি। এমন দুজন খামারি হলেন দাউদ এবং আল্লেক। তাদের গরুর সঙ্গে তোলা ছবিই নুরুন্নাহার নিজের বলে প্রচার চালিয়েছেন নানা সময়ে। অবশ্য দাউদ এবং আল্লেকের খামারেও এখন গরু নেই।
এ বিষয়ে দাউদ ও আল্লেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, এলাকায় নুরুন্নাহার বেশ প্রভাবশালী, অনেক ওপর মহলে তার যোগাযোগ আছে বলে তিনি প্রচার চালানোয় অনেকে তার অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে সাহস করেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবলু মালিথা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নুরুন্নাহার এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। এখন আওয়ামী লীগ সেজে স্থানীয় সংসদ সদস্যের (এমপি) কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন। তার ছোট একটা পুকুর আছে। ১৬০ বিঘার খামারের প্রশ্নই ওঠে না। সব মিলিয়ে তার ১০-১৫ বিঘার খামার হতে পারে। নুরুন্নাহার বিভিন্ন মানুষের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকেও সুবিধা নিচ্ছেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অফিসারের মাধ্যমে তিনি অগ্রণী ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ পাচ্ছেন অভিযোগ করে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘নুরুন্নাহারের কৃষি খামারে ঋণ দেয়ার আগে একবার অন্তত পরিদর্শন করুন, সত্যটি বেরিয়ে আসবে। সত্যিকারের স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত কৃষক যার জমি আছে পর্যাপ্ত, তিনি হলেন এ এলাকার শাহজাহান বাদশা। তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিঘা, বাকিরা সবাই খেলাপি।’
প্রায় শূন্য নুরুন্নাহারের কৃষি খামার, এই খামারকেই ভিত্তি করে পৌনে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছেন তিনি এ বিষয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘তার (নুরুন্নাহার) খামার বড় হতে পারে, শুনেছি সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন। অনেক আগে গিয়েছি, যেটা ১৬০ বিঘা হওয়ার কথা নয়।
নুরুন্নাহারের কৃষি খামারের অনুকূলে প্রশিক্ষণবাবদ সিএসআর খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল, সেটা প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়নি বলেও অভিযোগ মিলেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল কাদের বলেন, ট্রেনিংয়ের জন্য বরাদ্দ টাকা দিয়ে তিনি (নুরুন্নাহার) ভবন করেছেন, তবে ট্রেনিং করাননি। ট্রেনিং হলে আমি জানতাম, কারণ আমি (তখন) ঈশ্বরদী এলাকায় কৃষি অফিসার ছিলাম।
অন্যের ক্ষেত বা খামারে গিয়ে ছবি তুলে নুরুন্নাহার তা প্রচার করেন বলে অভিযোগ আছে যাদের পরিদর্শনের ভিত্তিতে নুরুন্নাহার ঋণ পাচ্ছেন, তাদের অন্যতম অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মঈনুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণ দেয়ার আগে তার খামার পরিদর্শন করেছি। কোনো অভিযোগ উঠলে প্রয়োজনে আমরা আবার পরিদর্শনে যাবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস-উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণ দেয়ার বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দেই। কোনো ধরনের মিথ্যা তথ্য দিলেই কেউ ঋণ পাবে না। তবে এটাও দেখতে হবে যেসব তথ্য আমি অন্যকে দিয়ে যাচ্ছি সেটাও সঠিক কি-না। তথ্য সঠিক না হলে অবশ্যই সে ঋণ পাবে না। ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা। নুরুন্নাহার আমাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, তিনি এ ব্যাংকের গ্রাহক। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুন্নাহার বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। এর আগে অগ্রণী ব্যাংকে আমার দুই কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণ ছিল। আমি গত বছরের জুন মাসে এক চেকে অগ্রণী ব্যাংকের দুই কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। এখন আর আমার কোনো ব্যাংক ঋণ নেই, অন্য ব্যাংকে আমি খেলাপিও নই।
যদিও নুরুন্নাহারের জন্য অগ্রণী ব্যংকের লোন স্যাংশন লেটারে (ঋণ অনুমোদনপত্রে) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারির সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী নুরুন্নাহার ও নুরুন্নাহার কৃষি খামারের কাছে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা দায়-দেনা বিদ্যমান রয়েছে। নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘নতুন করে আমি ঋণের জন্য আবেদন করেছি তবে ঋণ নিচ্ছি না করোনার কারণে। আমি ২৭০টি গাভী ও ষাড় গরু কিনবো, কিন্তু করোনার মাঝে লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে, তাই অপেক্ষা করছি। গাভীতে দুধ দেয়া শুরু হলে দুধের প্রজেক্টে হাত দিতে চাই। এখন গোয়ালে ২০টি গরু আছে।
নুরুন্নাহার বেগম আরও বলেন, ‘আমি একাধিকবার পদক পেয়েছি। আমি একটি খামার করবো যেখানে ঘি, মাখন, জ্যাম-জেলি বানাবো। এর আগে আমার খামার থেকে এমপি, এসপি, ডিসি সবাই গরু কিনেছেন। ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে সেখান থেকে দেখতে পারেন। আমি কেনো অন্যের খামারে যাবো? ব্যাংক এশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেয়ার পর যথাসময়ে পরিশোধে অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে তারা। আপনারা আমার প্রজেক্টটা দেখেন, ব্যাংকের কাছে যান, তারা ভিজিট করে, তথ্য পাবেন সেখানে।
সূত্র : জাগো নিউস ২৪