‘আমার ছেলে সুস্থ ছিল। বাড়িতে থাকতো। প্রায় ছয় মাস আগে নিখোঁজ হয়। অনেক জায়গায় খুঁজেও সন্ধান পাইনি। গত বুধবার ফেসবুকে ছবি দেখে চিনতে পারি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে মিল্টন সমাদ্দারের ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। কিন্তু পেটে বড় কাটা দাগ নিয়ে ভয় হয়। আমার ধারণা, তার পেট কেটে কিডনি বা অন্য কোনও অঙ্গ খুলে নেওয়া হয়েছে।’
শনিবার (১১ মে) সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেছেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মো. সেলিমের মা রাবেয়া বেগম। সেলিম (৪৫) ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃপাঁচাশি গ্রামের আবুল হাসিমের ছেলে। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ সেলিমের শরীরে কিডনি রয়েছে কিনা, তা জানতে শনিবার শহরের প্রান্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসককে দেখান। সেখানে রাবেয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির।
সেলিমকে উদ্ধার করে বাড়িতে আনার পর দেখি পেট কাটা, এতে আমার সন্দেহ ও ভয় হয় উল্লেখ করে রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের শরীরে কোনও কাটা দাগ ছিল না। আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন পেট কেটে কিডনি বা অন্য কোনও অঙ্গ খুলে ফেলেছে। ছয় মাস আগে বাড়িতে থাকা অবস্থায় ছেলে পরিবারের সবাইকে চিনতো। এখন কাউকে চিনতে পারে না। শুধু সবার দিকে তাকিয়ে থাকে। কারও সঙ্গে কথাবার্তাও বলে না। ক্ষুধা লাগলে মা-মা বলে। অনেক অসুস্থ। কিন্তু আমার ছেলে তো এমন ছিল না।’
সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ ছয় মাস আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি উল্লেখ করে সেলিমের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোথাও পাইনি। কয়েকদিন আগে মিল্টন সমাদ্দারের গ্রেফতারের খবর টেলিভিশনে দেখি। তখন আমার দেবর ও স্বজনরা ইউটিউবের ভিডিওতে মিল্টনের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের শয্যায় সেলিমকে শুয়ে থাকতে দেখে চিনে ফেলে। পরে ফেসবুকে ছবি দেখে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হই। গত বৃহস্পতিবার মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসি। আগে নিজে চলাফেরা করতে পারলেও এখন চলতে অন্যের সাহায্য লাগছে। গোসল করানোর সময় দেখি পেট বড় ধরনের কাটা দাগ। দুই পা ফোলা। কথাবার্তা বলতে পারে না। আমার মনে হয়, তার কিডনি কেটে ফেলেছে আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজন। এজন্য পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে ডাক্তার দেখাতে এনেছি। ডাক্তার দেখে আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেছেন। রিপোর্ট এলে বিস্তারিত জানাবেন বলেছেন। আমার স্বামীর সঙ্গে যারা এই অবিচার করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
সেলিমকে উদ্ধারের বর্ণনা দিয়ে চাচাতো ভাই আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ফেসবুকে ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেছি। সেদিন স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিই। পরে মিরপুর থানায় গিয়ে জিডি করি। জিডির কপি, পরিচয়পত্র এবং প্রত্যয়নপত্র নিয়ে মিরপুরের চাইল্ড কেয়ারে সেলিমকে দেখে চিনতে পারি। আমরা গিয়ে দেখি তার পা রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। শরীরে কোনও কাপড় নেই। পেটে বড় ধরনের কাটা। রাতে উদ্ধার করে বাড়িয়ে নিয়ে আসি। আজ এখানে আনার পর ডাক্তার দেখে কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট দেখার পর বিস্তারিত জানাবেন।’
প্রান্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেলিমকে দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের চিকিৎসক সৈয়দ হাসানুল হক আকাশ। তিনি বলেন, ‘পেটে বড় ধরনের কাটা দাগ রয়েছে। পায়ে পানি জমে ফুলে উঠেছে। আলট্রাসনোগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে, আসলে তার সঙ্গে কী ঘটনা ঘটেছিল।’
বড়হিত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজিজুল হক ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিরপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড কেয়ার থেকে সেলিমকে উদ্ধারের জন্য সব ধরনের সহায়তা করেছি। উদ্ধারের পর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, পেট কাটা। তাই পরীক্ষার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তার অঙ্গহানি ঘটে থাকে তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা পরিবারকে সহায়তা করবো।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ মাজেদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রম থেকে সেলিমকে উদ্ধারের বিষয়টি জানার পর বিস্তারিত খোঁজখবর জানতে পুলিশ পাঠিয়েছি। তবে পরিবার এখনও থানায় কোনও অভিযোগ দেয়নি। আসলে তার সঙ্গে কী হয়েছে, পেট কাটার প্রমাণ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেবো।’
প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১ মে রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে’ লোকজনকে মারধর ও আশ্রিত শিশুকে পাচারের অভিযোগে দুটি ও জালিয়াতির মাধ্যমে চিকিৎসক সেজে মৃত্যুসনদ দেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি মামলা করা হয়।
তাকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দারের অনেক ভয়াবহ রোমহর্ষ ঘটনা আছে। আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষকে টর্চার সেলে পেটাতেন। রাতের বেলায় মৃতদের জানাজা করাতেন, মৃত্যু সনদে নিজেই সিল-ছাপ্পর মারতেন। আসলে সে ভয়ঙ্কর সাইকোপ্যাথে পরিণত হয়েছিল।’