রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা।
দামের চাপে তারা মাছ, মাংস খাওয়া অনেকটা ভুলতে বসেছে। তরিতরকারির মধ্যে একমাত্র আলু ছাড়া প্রায় সব জিনিসের দাম তাদের নাগালের বাইরে।
প্রশাসনসহ যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের মধ্যে জনগণের ওপর এই লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। যদি তাদের এটা স্পর্শ করত, তাহলে শহর, বন্দর, হাটবাজারে সার্বক্ষণিক তদারকি চোখে পড়ত।
উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-সবাই যেন নির্বিকার। তৃণমূলে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের এ নীরবতা সরকারের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের অবশ্যই বিশ্ববাজারে ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং যুদ্ধের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। সরকার অসহায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে টিসিবি কার্ডের মাধ্যমে সহনীয় দামে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে।
কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সরকারি কর্মচারী, পেনশনভোগীরা এর আওতার বাইরে থাকছেন। বিশেষ করে ২য়, ৩য়, ৪র্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীসহ পেনশনভোগীদের টিসিবি কর্তৃক ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা এ সময়ে জরুরি। তাদের মহার্ঘভাতা ও চিকিৎসাভাতা সময়ক্ষেপণ না করে বৃদ্ধি করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।
দেশের জনগণ এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কশাঘাতে হাবুডুবু খাচ্ছে। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নয়, ওষুধপত্রের দামও সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমার পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের ওষুধের পেছনে ব্যয় ছিল আগে ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। সরকার কিছু ওষুধের দাম বেঁধে দিলেও খুচরা পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশ্ববাজারে ডলার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে আমদানি করা ওষুধ যে যার মতো বিক্রি করছে। উচ্চমূল্য জোগাতে অপারগ হয়ে অনেকে ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণ রোগ প্রতিরোধে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার ও ওষুধ সেবন বন্ধ করলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে; যা দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে সবচেয়ে বেশি কষ্টের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন প্রবীণরা। উচ্চমূল্যের পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পেরে তারা অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে ওষুধপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণেও তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝে রয়েছেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধে থাকে। এ অসহায়ত্বের মাঝে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। প্রবীণরা দেশ ও সমাজের অভিজ্ঞ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ সম্পদ। অযত্ন-অবহেলায় নিঃশেষ হয়ে তাদের ধুঁকে ধুঁকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা কাম্য নয়। প্রতিটি এলাকায় প্রবীণদের দেখভাল করার জন্য জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন, এটিই কাম্য। পাশাপাশি সরকারি পেনশনভোগীদের চিকিৎসাভাতা ২৫০০ টাকার পরিবর্তে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ১০,০০০ টাকা, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ৫০০০ টাকা এবং সব সরকারি কর্মচারীর জন্য সর্বনিম্ন চিকিৎসাভাতা ২৫০০ টাকা প্রদান করা আজ যৌক্তিক প্রত্যাশা।
শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের জন্য বর্তমানে সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ১৫ বছর পর আবার পেনশন পুনঃস্থাপন। তবে খুব কমসংখ্যক পেনশনভোগীই ১৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। তাই এ উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ১৫ বছরের স্থলে ৮ বছর পেনশন পুনঃস্থাপনের বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। পেনশনভোগীদের জন্য প্রতিবছর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রদানের মাধ্যমে চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের (ষাট ও ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি) সব যানবাহনে ভাড়াবিহীন যাতায়াতের সুযোগ প্রদান করে রাষ্ট্র ও সমাজ এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত রাখতে পারে।
বিগত সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছিল নগণ্য। বর্তমান সরকার বেতন-ভাতা দুইগুণ বৃদ্ধি করার পর কর্মচারীদের মাঝে স্বস্তি বিরাজ করলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমানে তারা অস্বস্তিতে আছেন। সরকারি কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া ভাতা পেয়ে থাকেন। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া ভাতা পান না। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া না দেওয়া অমানবিক। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখবেন। আজও পেনশনভোগীদের মাঝে এক অমানবিক বৈষম্য চলে আসছে। জুনিয়র পেনশনভোগীর তুলনায় সিনিয়র পেনশনভোগীরা অতি নগণ্য ভাতা পেয়ে থাকেন। ভাবখানা এমন যে, সিনিয়র পেনশনভোগীরা তো স্বাভাবিক নিয়মে আগে মৃত্যুবরণ করবেন, তাদের বেতন বেশি দিয়ে কী হবে! এ বৈষম্য স্বাধীন দেশের জন্য হৃদয়বিদারক।
রাষ্ট্রের পেনশনভোগীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রকৃষ্ট একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি-বর্তমান সরকারের আগে সরকারি কর্মচারীসহ পেনশনভোগীরা মাসের বিভিন্ন তারিখে বেতন-ভাতা পেতেন। বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ ইএফটির মাধ্যমে সবাই বেতন-ভাতা মাসের ১ তারিখে পেয়ে আসছেন। পেনশনভোগীদের হিসাবরক্ষক কার্যালয়ে বছরে একবার সরেজমিন উপস্থিত হয়ে পেনশন নবায়ন করতে হয়। এ বছর ঢাকায় প্রধান হিসাবরক্ষণ অফিসে পেনশন শাখায় নবায়ন করতে গিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। রিকশা থেকে নামার পর একজন আনসার সালাম দিয়ে পেনশন শাখায় কর্মরত কর্মচারীদের মাধ্যমে সম্মানের সঙ্গে, যত্নের সঙ্গে লিফটে তুলে নিলেন। যাদের চলাফেরা করতে অসুবিধা, তাদের যত্নের সঙ্গে ধরে পেনশন শাখায় নিয়ে বসাচ্ছেন। বসানোর সঙ্গে সঙ্গে এক গ্লাস পানি, উন্নত মানের বিস্কুট ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। আবার অসুস্থদের যত্নের সঙ্গে যানবাহনে তুলে দেওয়া হয়। অসহায় সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সরকারের হিসাবরক্ষণ অফিসের এ উদ্যোগ সারা দেশের সবার মাঝে উদাহরণ হয়ে থাকুক।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে থামাতে হবে সংশ্লিষ্টদের। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সবার। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সবার দুঃখ-কষ্টের অবসান হোক-এটাই প্রত্যাশা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ