মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় দুই শতাধিক ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। খাসজমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও ঘর। এর মধ্যে উপজেলার ঠেঙ্গারবান্ধ এলাকায় ২০টি ঘর নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে একটি কমিটি। কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে আছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালিয়াকৈরের মৌচাক ইউনিয়নের কৌচাকুড়ি, ভলুয়া, মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চাঁনপুর, হাটুরিয়াচালা, নাগচালা, ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের মজিদ চালা ও বান্দাবাড়ি গ্রামে ২৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। সেগুলো গৃহহীনদের মধ্যে হস্তান্তরও করা হয়েছে। নতুন করে উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের ঠেঙ্গারবান্ধ এলাকায় ৭০টি ঘর নির্মাণ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এখন সেখানে বিদ্যুতের সংযোগ ও রঙের কাজ বাকি রয়েছে। নতুন করে আরও ২০ ঘর তৈরির কাজ চলমান।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঠেঙ্গারবান্ধ এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা একরামুল ইসলাম সড়কের পাশে ২০টি ঘর নির্মাণের জন্য কয়েক হাজার ইট আনা হয়েছে, যেগুলোর মান খুবই নিম্নমানের। ইট ব্যবসায়ীদের ভাষায়, এগুলো ‘৩ নম্বর’ ইট। ইটের গাঁথুনির জন্য যে বালু–সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তা–ও নিম্নমানের। ঢালাইয়ে এক বস্তা সিমেন্টের সঙ্গে যে পরিমাণ বালু দেওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি বালু ব্যবহার হচ্ছে। ফলে হালকা ধাক্কাতেই ইটের গাঁথুনি খুলে যাচ্ছে। ঘরের ভিত তৈরির জন্য গর্ত করা হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘর নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত একজন রাজমিস্ত্রি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এহানে ঘর করার লাইগা যে ইট আনা হইছে, হেই ইটা দিয়া মানুষ রাস্তাও বানাইবো না। হাত দিয়া উঁচা করলেই অনেক ইট ভাইঙা যাইতাছে। এই এলাকার মাটি অনেক শক্ত হের লাইগা ঘর দাঁড়ায় থাকে। নরম মাটি হইলে ঘর বাতাসেই পইরা যাইতো।’
কালিয়াকৈরের ইউএনও তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ‘এই ইট দিয়ে আমরা ঘরের ভিত তৈরি করেছি। এখন ইটের ক্রাইসিস চলছে। কোথাও ভালো ইট পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে ঘরের গাঁথুনির জন্য ভালো ইট ব্যবহার করা হবে। আপনারা যেহেতু খারাপ বলেছেন, তাই এই ইট আর ব্যবহার করা হবে না। এখনই নিষেধ করে দিচ্ছি।’
নির্দেশিকা অনুসারে ঘরগুলো নির্মাণে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা রয়েছে। নকশা মোতাবেক ইটের সংখ্যা, সিমেন্ট ও বালুর পরিমাণও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের সঙ্গে কোনো কিছুরই মিল পাওয়া যায়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে কমিটি থাকলেও কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মধ্যপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসার সময় ঘর করছে দেখছি। কিন্তু আমাকে কখনো এই ঘর নির্মাণের বিষয়ে অবহিত করা হয়নি বা দেখভাল করার কথা বলা হয়নি।’
ঘরগুলোর নির্মাণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু দ্রুত কাজ সম্পন্ন করায় কাজের মান ঠিক থাকছে না বলে দাবি এলাকাবাসীর। ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত এ ঘরগুলো রঙিন টিনের দুই কামরার সেমিপাকা করা হবে। প্রতিটি ঘরের আয়তন হবে দৈর্ঘ্যে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি, প্রস্থে ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। সঙ্গে থাকবে রান্নাঘর ও শৌচাগার। প্রতিটি ১০ ঘরের জন্য একটি নলকূপ। সব মিলিয়ে ঘরপ্রতি খরচ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা।
নির্মাণকাজ কমিটির সরাসরি করার কথা থাকলেও কাজ দেওয়া হয়েছে আশরাফুল ইসলাম নামের এক ঠিকাদারকে। মালামাল ক্রয়ে নিজের কোনো হাত নেই জানিয়ে আশরাফুল বলেন, ‘আমি আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনেক ঘর নির্মাণ করেছি। কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। এখানে আমি শুধু কাজের দায়িত্ব নিয়েছি, মালামাল দিচ্ছে প্রশাসনের লোক। ইটগুলো ৩ নম্বর আসায় আমিও তাদের জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন জানিয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ইট খারাপ হলে কোনোভাবেই তা ঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হবে না।