পঞ্চগড় আদালতের নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম, বিচারকসহ কর্মকর্তারা ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ
বাংলাদেশ

পঞ্চগড় আদালতের নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম, বিচারকসহ কর্মকর্তারা ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ

পঞ্চগড়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে লিখিত পরীক্ষা বর্জন করেছেন পরীক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে বিক্ষোভ করে স্বচ্ছ পরীক্ষার দাবিতে বিচারকসহ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন তারা। এ অবস্থায় এই নিয়োগের সব পরীক্ষা অনিবার্য কারণ দেখিয়ে স্থগিত ঘোষণা করেছে নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটি।

শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল সোয়া ১০টার পর থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পঞ্চগড়ের মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান ও পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান মন্ডলসহ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন পরীক্ষার্থীরা। দুপুর দেড়টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান মন্ডল পরীক্ষা সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেইসঙ্গে অবরুদ্ধ থেকে মুক্ত হন তারা।

পরীক্ষা সংক্রান্ত কমিটি ও বিক্ষোভকারী পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চগড় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট ১২টি পদে ৩০ জন নিয়োগের জন্য মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবার সকাল-বিকাল পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। প্রথম দিন বেঞ্চ সহকারী ও মালি পদের জন্য প্রায় এক হাজার পরীক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা ছিল।

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনও কোনও পরীক্ষার কক্ষ সময়মতো খুলে দেওয়া হলেও বেশিরভাগ কক্ষ খোলা হয়েছে ১০-১৫ মিনিট দেরিতে। এমনকি পরীক্ষার কক্ষে কোনও আসন বিন্যাস না থাকায় যে যার মতো করে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। এমনকি প্রশ্নপত্র খোলাভাবে পরীক্ষার কক্ষে এনে দেওয়া হচ্ছিল। এতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সন্দেহ তৈরি হয়। কোনও কোনও পরীক্ষার্থী মোবাইলে সার্চ দিয়ে উত্তর খুঁজে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। অনেকের প্রায় ১৫ মিনিট পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেলেও কেউ কেউ বসার জায়গা পাচ্ছিলেন না। পরীক্ষার কক্ষে আদালতের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এসব অব্যবস্থাপনা দেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। পরে তারা পরীক্ষা বর্জন করে সবাই একত্র হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় কেউ কেউ কলেজের শ্রেণিকক্ষের জানালার কাচ ও বসার বেঞ্চ ভাঙচুর করেছেন।

একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে এসে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন এবং কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করেন। পরে পরীক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান ও পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান মন্ডল, মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর আলম, অন্যান্য বিচারক ও কর্মকর্তা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী ও পুলিশ আলোচনা বসে। এ সময় পরীক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পরীক্ষা বাতিল, নিয়োগ কমিটি বাতিল ও অব্যবস্থাপনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়।

কর্মকর্তাদের তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন পরীক্ষার্থীরা

এ অবস্থায় পঞ্চগড় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের শুক্রবার ও শনিবারের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সদস্যসচিব ও পঞ্চগড়ের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশরাফুজ্জামান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি ‘জুডিশিয়ারি পঞ্চগড়’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এতে এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার পরবর্তী সময়সূচি জানানো হবে বলা হয়।

তারপরও কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে বাইরে পরীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১টার দিকে আলোচনা শেষে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান ও পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এ ছাড়া পরীক্ষার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করে আবারও প্রবেশপত্র দেওয়া হবে বলে জানান। তিনি পরীক্ষা সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। দুপুর দেড়টার দিকে বিক্ষোভকারীরা সেখান থেকে চলে গেলে অবরুদ্ধ থেকে মুক্ত হন কর্মকর্তারা।

বেঞ্চ সহকারী পদে পরীক্ষার্থী মোহাম্মদ শাহজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কক্ষে পরীক্ষার্থী ছিল ৭০ জন। প্রশ্নপত্র এসেছে ৫০টি। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে কিন্তু আমরা অনেকে বসার জায়গা পাইনি। এর মধ্যে নিয়োগ কমিটির বাছাইকৃতদের প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে, তারা লিখতেছিল। তখনও আমরা দাঁড়িয়ে আছি।’

সিফাত হাসান নামের আরেক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘নতুন স্বাধীন দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি হবে, এজন্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। প্রশ্নফাঁসে জড়িত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের শাস্তিসহ বদলির দাবি জানাই।’

পরীক্ষার্থী শামীমা আক্তার বলেন, ‘পরীক্ষার কক্ষে গিয়ে দেখি আমাদের সিট প্ল্যান নেই। যে যার মতো করে বসেছে। আবার কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। এরই মধ্যে ১০টা বেজে ১০ মিনিট হলেও আমাদের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়নি। অথচ অন্য কক্ষগুলোতে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। এভাবে অনেকের সঙ্গে হয়েছে। পরে সবাই বাইরে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করি।’

আব্দুল্লাহ আরিফ বলেন, ‘অনেকে মোবাইল থেকে উত্তর সংগ্রহ করে খাতায় লিখছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের দায়িত্বশীলরা বাধা দেননি। পরে শুনি, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এর সঙ্গে কর্মকর্তা কর্মচারীরা জড়িত আছেন।’

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান মন্ডল অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়

মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আদালত কর্তৃপক্ষ এই পরীক্ষার বিষয়ে আমাদের কাছে ভেন্যু চাওয়া ছাড়া আর কোনও যোগাযোগ করেননি। এমনকি কোন কোন কক্ষে পরীক্ষা নেবেন, তার কোনও তালিকাও দেননি। বৃহস্পতিবার আমি নিজে ফোন করেছি, কিন্তু তারা রিসিভ করেননি। তাদের সিট প্ল্যান ছিল না। এতে ব্যাপক অব্যবস্থাপনা ছিল। পরে বিক্ষোভকারীরা আমাদের শ্রেণিকক্ষের জানালাসহ বিভিন্ন আসবাব ভাঙচুর করেছেন। আমরা এসব ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালত কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানাবো।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড়ের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা সবাই মিলে ১০ দফা দাবি পেশ করেছি। এর মধ্যে পরীক্ষা বাতিল, বর্তমান নিয়োগ কমিটি বাতিল করে নতুন নিয়োগ কমিটি গঠন, নিয়োগ কমিটিতে ডিসি, এসপি, সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক প্রতিনিধি, জজ কোর্টের প্রতিনিধি রাখতে হবে, শুধুমাত্র পঞ্চগড়ের বাসিন্দাদের নিয়োগ দিতে হবে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, সব পরীক্ষার্থীকে নতুন করে প্রবেশপত্র দিতে হবে উল্লেখযোগ্য। তবে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দাবি মেনে নিয়েছে নিয়োগ কমিটি।’

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এস. এম. ইমাম রাজী টুলু বলেন, ‘পরীক্ষার্থী, সমন্বয়ক, পুলিশ, বিচারক ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে আলোচনা করে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের দাবি ও অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান মন্ডল বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির কয়েকটি মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রশ্নফাঁসসহ বাকি অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে পরে প্রবেশপত্র সরবরাহ করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হবে।’

Source link

Related posts

চট্টগ্রামে একদিনে আরও তিনজনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১৯

News Desk

বরগুনার লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড: ভয়াল সেই রাতের দুই বছর পূর্তি

News Desk

খুবিতে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে জিমনেশিয়াম নির্মাণকাজের উদ্বোধন

News Desk

Leave a Comment