পীরের কথায় ৫২ বছর ভোট দেন না ৯ গ্রামের নারীরা, কবে দূর হবে কুসংস্কার?
বাংলাদেশ

পীরের কথায় ৫২ বছর ভোট দেন না ৯ গ্রামের নারীরা, কবে দূর হবে কুসংস্কার?

স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, অফিস-আদালত ও বিভিন্ন জায়গায় পুরুষের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলছেন নারীরা। শুধু নির্বাচনে ভোট দিতেই বিপত্তি চাঁদপুরের এক ইউনিয়নের ৯টি গ্রামের নারীদের। বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তথাকথিত এক পীরের কথার জের ধরে দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে ভোট দেন না হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের নারী ভোটার। এমনকি এখানকার অনেক নারী মনে করেন, তাদের ভোট দেওয়ার অধিকার নেই।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, শুধুমাত্র কুসংস্কারের কারণে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন না ওই ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ, গৃদকালিন্দিয়া ও চরমান্দারি গ্রামসহ ৯ গ্রামের নারীরা। প্রতিবার নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রশাসন বহু চেষ্টা করলেও তাদের ভোটকেন্দ্রে নিতে পারছে না। তবে ভোট দিতে আগ্রহী তরুণ ভোটাররা। গত ইউপি নির্বাচনে দুই-একজন নারী ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারতের জৈনপুর থেকে আসা এক পীর খানকা স্থাপন করেন ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৬ নম্বর রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে। ওই সময় এলাকাটিতে মহামারি কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন চলছিল স্থানীয় নির্বাচন। জৈনপুরের পীর ওই সময় ফতোয়া দেন নারীরা যেন ‘বেপর্দা’ অবস্থায় ঘর থেকে বের না হন। এরপর থেকে কুসংস্কার গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ভোটদানে ধর্মে বিধিনিষেধ না থাকলেও বিরত থাকছেন ৯টি গ্রামের নারীরা। এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ৫২ বছর। এখনও ভোট না দেওয়ার ধারায় রয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, মুসলিম নারীদের উদ্দেশে পীর ওই ফতোয়া দিলেও ইউনিয়নের হিন্দু-খ্রিষ্টান নারীরাও ভোটদান থেকে বিরত রয়েছেন। 

তবে এখানকার নারীরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি আবাদ থেকে শুরু করে হাট-বাজার, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা সব ক্ষেত্রেই অবদান রাখছেন। শিক্ষার হারেও পিছিয়ে নেই। শুধু ভোটেই বিপত্তি।

উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে ২৪ হাজার ৪৫৪ জন ভোটার। এর মধ্যে ১২ হাজার ১১৪ জন নারী ভোটার। পুরুষের ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারও পুরুষের ভোটে নির্বাচিত হন। কারণ নারীরা ভোট দিচ্ছেন না। ভোটদানে তাদের উৎসাহিত করতে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, নির্বাচন অফিস বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করেছেন। কিন্তু ভোটের দিন কেন্দ্রে আসছেন না নারীরা। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) খুকি বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনের সময় আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের ভোট দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলাম, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিছু কোনও নারী ভোটার কেন্দ্রে আসেননি। অন্যান্য নির্বাচনেও ভোট দিতে কেন্দ্রে আসেন না তারা।’

বছরের পর বছর এই কুসংস্কার চলে আসছে উল্লেখ করে খুকি বেগম বলেন, ‘তাদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে বললে তারা বলেন, পীরের কথা অমান্য করে ভোট দিতে গেলে যদি গ্রামে রোগবালাই বা কোনও বিপদ এসে পড়ে তাহলে তার দায় নেবে কে? অধিকাংশ নারী একই কথা বলেন। এই অবস্থায় আমরা চুপ হয়ে যাই। অথচ সব নারী হাট-বাজারে যান, অফিস-আদালতে কাজও করেন। কিন্তু ভোট দেন না।’

একই কুসংস্কারের কথা বলেছেন রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শরীফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনেছি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের জৈনপুর থেকে আসা এক পীর এই ফতোয়া দিয়েছিলেন। ওই সময়ে এই অঞ্চলে ডায়রিয়া-কলেরাসহ অনেক রোগবালাই হতো। বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তখন পীর নারীদের বলেছিলেন, আপনারা ঘর থেকে কম বের হন, পর্দাশীল থাকেন। তখনকার সময়ে যারা এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার ও সমাজপতি ছিলেন তারা বিষয়টিকে অন্যভাবে নিয়ে নারীদের ভোটদান থেকে বিরত রাখেন। ওই কুসংস্কার মেনে এখনও নারীরা ভোট দেন না।’

ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ বাজারে কেনাকাটা করছেন নারীরা

প্রতি নির্বাচনের সময় নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে সচেতনতামূলক সভা-বৈঠকের আয়োজন করি উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘কিন্তু ভোটের দিন দেখা যায়, আগের অবস্থা। এবারও স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে উঠান বৈঠক করেছি। ইউপি সদস্যের মাধ্যমে বৈঠক করে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেছি। এখনও আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এখন দেখার পালা এবারের ভোটে এই কুসংস্কার দূর হয় কিনা।’

ভোট না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে রূপসা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ গ্রামের ভোটার নন্দিতা রানি বলেন, ‘আমাদের ভোট নেই। জৈনপুর হুজুরে নিষেধ করেছিলেন। হুজুরের কথা তো মানতে হবে। আমরা হিন্দু ধর্মের হলে কী হবে, হুজুর তো সবার একই। আমরা জৈনপুর হুজুরের কথা মেনেই ভোট দিতে যাই না।’

একই গ্রামের মিনু রানি বলেন, ‘২০ বছর ধরে এই গ্রামে বসবাস করছি। হুজুরে নিষেধ করায় একবারও ভোট দিতে যাইনি। একবার এক নারী ভোট দেওয়ার পর ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। এজন্য অন্য নারীরা ভোট দিতে সাহস পায় না। চেয়ারম্যান-মেম্বার বললেও আমরা ভোট দিতে যাবো না।’

রুপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদে সেবা নিতে আসা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমাদের এখানে পুরুষরা ভোট দেয়, কিন্তু নারীরা দিই না। জৈনপুর হুজুরের নির্দেশ মেনে ভোট দিই না আমরা। এবারও কেন্দ্রে যাবো না।’

তবে তরুণ ভোটার খাদিজা আক্তার বলেন, ‘অধিকাংশ নারী ভোট দিতে যান না। তবে আমরা যারা বর্তমান প্রজন্মের তারা ভোট দিতে যাবো এবার। ভোট আমাদের অধিকার। গত ইউপি নির্বাচনেও ভোট দিয়েছিলাম। তবে পর্দা মেনে ভোট দেওয়া উচিত নারীদের।’

ফরিদগঞ্জে জৈনপুর জামে মসজিদ

রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব রাবেয়া বশরী বলেন, ‘মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি, জৈনপুর হুজুর একসময় নারীদের পর্দায় থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নারীরা ধরে নিয়েছেন ভোট দিতে নিষেধ করেছেন। অথচ তারা বাজারে যাচ্ছেন, অফিস করছেন, স্কুল-কলেজসহ সব জায়গায় যাচ্ছেন। কিন্তু ভোটের সময় এলেই হুজুরের কথা মানেন। গত নির্বাচনগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করেছিল। কিন্তু ভোট দিতে আসেননি নারীরা। যেসব নারী এখানে সেবা নিতে আসেন তাদের ভোট দেওয়ার কথা বলি, সচেতন করার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই কুসংস্কারে ডুবে থাকেন তারা।’

এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘ওই ইউনিয়নের নারী ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করেছি। সভায় কয়েকশ নারী ভোটার উপস্থিত ছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়া এবার নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি ও যারা নারীদের নিয়ে কাজ করেন, তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি, এবার নারীরা ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন।’

জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘সচেতনতামূলক সভার মাধ্যমে ওই ইউনিয়নের নারীদের আমরা বুঝিয়েছি। দেশের অগ্রযাত্রা এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারীদের অংশগ্রহণ দরকার। সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ জরুরি, এসব বিষয় তাদের বোঝানো হয়েছে। সভায় যারা এসেছিলেন তারা সবাই হাত তুলে আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবার ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন তারা।’

Source link

Related posts

ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত

News Desk

গাজীপুর থেকে ঢাকায় শুরু ট্রেন চলাচল

News Desk

বিগবস কারখানায় আগুন

News Desk

Leave a Comment