পুরস্কার নেওয়ার পরই শেষ অরন্য চিরান ‘বিতর্ক’
বাংলাদেশ

পুরস্কার নেওয়ার পরই শেষ অরন্য চিরান ‘বিতর্ক’

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়ার জন্য গত ১৫ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সারা দেশের ১০ জনের সঙ্গে ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়ার প্রত্যন্ত দিঘলবাগ গ্রামের অরন্য চিরানের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে সৃষ্টি হয় নানা বিতর্কের। পদক তালিকা থেকে তার নাম বাতিলের দাবিতে মানববন্ধনসহ নানা আন্দোলনে সোচ্চার হয় একাধিক সংগঠন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে অরন্য চিরান স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করার পর থেমে গেছে আন্দোলন, নেই আর কোনও বিতর্ক। এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হচ্ছে সংবর্ধনা।

পদক পাওয়া নিয়ে বিরোধীতা এবং আন্দোলন সম্পর্কে অরন্য চিরান বলেন, ‘কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্র আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ায় আমি খুবই খুশি। ত্রিশ বছর ধরে আমি আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে আসছি। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। তাদের নানা সমস্যায় পাশে থেকেছি। তবে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক পাবো, এটা ভাবনাতেই ছিল না।’

তিনি জানান, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যারা হেরেছে তারা আমার প্রতিপক্ষ হয়ে বিরোধিতা করেছে এবং আন্দোলনে ইন্ধন দিয়েছে। এছাড়া আদিবাসীদের আরেকটি পক্ষ দুর্নীতি এবং নানা অপকর্মের কারণে কেন্দ্রীয় ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে যাদের সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছিল, তারা আমার সঙ্গে শত্রুতাবশত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্টাপাল্টা লেখালেখি করে। তবে সব কিছুর অবসান ঘটেছে, পদক পাওয়ার পর সব আন্দোলন থেমে গেছে। 

স্বাধীনতা পদক পাওয়া অরন্য চিরান ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ‘পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাদের জন্য আবাসনসহ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে কাজ করতে চাই। এছাড়া যারা সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহে আসেন তাদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলার ইচ্ছা আছে। এই আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে অসহায় মানুষ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে যাবে।’ 

আদিবাসী লেখক ও সমাজসেবক অরন্য চিরান ৪৪ বছর বয়সেই সমাজসেবায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই পদক পেয়েছেন। এত অল্প বয়সে কীভাবে তিনি পদকটি পেলেন মূলত তা নিয়ে ময়মনসিংহ এবং ধোবাউড়া-হালুয়াঘাটে শুরু হয় বিতর্ক।

এ বিষয়ে আদিবাসী সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সদর শাখার সভাপতি বিপুল হাজং বলেন, ‘অরন্য চিরান একজন এনজিওকর্মী। তিনি সমাজ সেবায় অবদান রেখেছেন এমন কোনও কর্মকাণ্ড দেখিনি। এই জন্যই পদক তালিকা থেকে তার নাম বাতিলের দাবিতে আাদিবাসীসহ সব স্তরের মানুষের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছিলাম। নাম বাতিলের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ায় আমরা হতাশ।’

এ ব্যাপারে ধোবাউড়ার নয়াপাড়া গ্রামের আদিবাসী কবি সাহিত্যিক মতিন্দ্র মানখিন বলেন, ‘অরন্য চিরান একজন ভালো মনের মানুষ। তিনি আমার অসুস্থতার সময় পাশে থেকে সেবা করেছেন। এছাড়া দিঘলবাগ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লুরেন রিছিল রংদি, রাজ্জাক চিরান, এটিশন মানকিন প্রমুখকে সরকারিভাবে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ব্যাক্তিগতভাবেও সহযোগিতা করেছেন। আদিবাসীদের দাবি আদায়ে তিনি সব সময় আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।’

ধোবাউড়া ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এডুয়ার্ড নাফাক বলেন, ‘অরন্য চিরান আদিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যায় পাশে থেকে সহযোগিতা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।’

এলাকার ব্যবসায়ী সুকান্ত সাংমা জানান, অরন্য চিরান ছোটবেলা থেকেই ময়মনসিংহ শহরে থাকেন। এলাকা থেকে শহরে গেলেও নানা সমস্যায় মানুষকে সেবা দিয়ে থাকেন। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সনদপত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে পাইয়ে দিতে কাজ করেন। তার পদক পাওয়ার বিষয়টি অনেকেই মানতে পারেননি বলেই নানা বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে অরন্য চিরানের স্বাধীনতা পদক পাওয়ায় আদিবাসীদের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ করছেন অরন্য চিরান

এক নজরে অরন্য চিরান

অরন্য চিরান ‘সারা’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার কেন্দ্রীয় কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর কলমাকান্দা এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় আদিবাসীদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। অসহায়-দুস্থ মানুষের সেবায় সব সময় নিয়োজিত থাকেন। আদিবাসীদের জীবনধারাসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তিনি বই লিখেছেন। কর্মজীবনের শুরুতে মনসাপাড়া অ্যাডভেন্টিস্ট মিশনারি স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি টাঙ্গাইল জেলার অর্ন্তগত মধুপুর উপজেলায় রামজীবন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৯৮-২০০০ সাল পর্যন্ত এবং ধোবাউড়ার মনসাপাড়া এসডিএ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত সেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় তিনি একটি উন্নতমানের বিজ্ঞানাগার গড়ে তুলেছিলেন। যা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। হালুয়াঘাট ট্রাইবালের উন্নয়নে কাজ করেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে তিনি সহায়তা করেছেন। ২০১০ সালে পাদদেশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন থেকেই নানা রকম সমাজ সেবামূলক কাজে সম্পৃক্ত। তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সেবায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিশেষ করে হরিজন পল্লীর শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে সমতা আনয়নের জন্য সচেতনতা সৃষ্টি, গারো পাহাড়ের দুর্গম পাদদেশ এলাকায় অবস্থিত সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকা গারোদের নানা সমস্যা মোকাবিলায় যেমন সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছেন, তেমনি তাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্যও নিবেদিত। হাজংদের ওপর একটি বিষয়ে গবেষণায় তিনিই প্রথম এমফিল সম্পন্ন করে বর্তমানে পিএইচডি করছেন।

অরন্য চিরান শেরপুর কৃষি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং পরে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করে পিএইচডি গবেষণারত আছেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমি, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা, বৃহত্তর ময়মনসিংহের আদিবাসী সংগঠনগুলোর ঐক্য পরিষদ, জেলা ব্র্যান্ডিং কমিটি, জেলা সামাজিক সম্প্রীতি কমিটি, সারা সংস্থা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ স্কলার অ্যাসোসিয়েশনসহ অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের গুরত্বপূর্ণ পদে যুক্ত থেকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে উন্নয়নের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত প্রদান করে তাদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিষয়ক সভা-সেমিনার, গারোদের ওয়ানগালা উৎসব ও হাজংদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যাদুঘর স্থাপন ও সংরক্ষণ এবং চুগান উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি সংরক্ষণে তার অবদান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ আচিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য- ‘আমি প্রমোদ মানকিনের কথা বলছি’, ‘বিচিত্র দৃশ্যপট’, ‘তের কবির পঙ্কতিমালা’, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের কাব্যগ্রন্থ’, ‘জ্যোৎস্না নেই পূর্ণিমা নেই’, ‘স্বপ্নের ভুবন’। তিনি ‘মাদার তেরেসা শাইনিং পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’, প্রথম ‘গারো গবেষক, লেখক ও কবি সম্মেলন সাহিত্য পদক-২০১৩’ এবং ‘শিশুকবি রকি সাহিত্য পুরস্কার-২০১১’ সম্মাননায় ভূষিত হন।

Source link

Related posts

দৌলতদিয়ায় ঘরমুখী মানুষের উপচে পড়া ভিড়

News Desk

রোডমার্চ শেষে খুলনায় সমাবেশে যা বললেন বিএনপি নেতারা

News Desk

ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা

News Desk

Leave a Comment