গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পর পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে অনেক শ্রমিক তাদের নিজ গ্রামে চলে গেছেন।
শুক্রবার (১০ নভেম্বর) বিকালে এ ঘটনায় জড়িত থাকা সন্দেহে গ্রেফতার ১১ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) রাতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কোনাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখান করে অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার ৯টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া আরও ২২টি কারখানা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশ।
যেসব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে
কাইজার নিট ওয়্যার, এম এম নিট ওয়্যার, মণ্ডল ফেব্রিক্স, কটন ক্লাব, এমবি ফ্যাশন (অনন্ত গার্মেন্টস), এমা সিনটেক্স, আইটিএলএস ফ্যাশন, রিপন নিট ওয়্যার, ইসলাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও তুসুকা প্রসেসিং লিমিটেড। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ১৩ (১) ধারা মোতাবেক বন্ধ কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কারখানার সম্পত্তি এবং জানমাল রক্ষার স্বার্থে পরবর্তী কাজের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারখানার সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মামলার বাদী এসআই আবু সাঈদ জানান, বৃহস্পতিবার মহানগরীর কোনাবাড়ী বিসিক এলাকায় তুসুকা কারখানায় শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে ভাঙচুর করেন। এ সময় তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কারখানার সামনে থাকা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপকমিশনারের (ডিসি) গাড়ি ভাঙচুর করেন। ওই সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন কারখানার ১১ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করে। ঘটনাস্থলে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও সংগ্রহ করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তুসুকা কারখানার মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাসুম হোসেন জানান, অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলে কারখানা খোলার তারিখ শ্রমিকদের জানিয়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও কোনাবাড়ি আমবাগ রোডের এমএম নিট ওয়্যার লিমিটেড ও কোনাবাড়ি জরুন এলাকার ইসলাম গ্রুপের কারখানার এক নারী শ্রমিক আহত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় ওই গ্রুপের তিনটি কারখানার সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি ও আশপাশের এলাকার ২২টি কারখানা বন্ধের খবর তাদের কাছে রয়েছে বলে জানান গাজীপুর শিল্প পুলিশ জোন-২ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহমেদ।
কারখানার পরিচয় না দেওয়ার শর্তে নারী শ্রমিক জেসমিন আক্তার, সুফিয়া বেগমসহ তাদের অন্যান্য সহকর্মীরা বলেন, ‘কখন আন্দোলন শুরু হয়, কীভাবে শুরু হয় বুঝতে পারি না। শুধু ঝামেলা হলে একদিকে দৌড়ে পালাই। এখন শুনলাম হাজার হাজার শ্রমিকের নামে মামলা হয়েছে। যাকে ধরবে সেই নাকি আসামি। আমরা তো অপরাধ করিনি, তবুও ভয়ে আছি।’
একাধিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাগাতার শ্রমিক বিক্ষোভ, ভাঙচুর এবং শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর, জরুন, কোনাবাড়ি, আমবাগ এবং ভোগরা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আন্দোলনের ঘটনায় একাধিক মামলা হওয়ায় গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন শ্রমিকরা। কারখানা খোলার পর কাজে যোগ দেওয়া নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন তারা। আন্দোলনে জড়িত অধিকাংশ শ্রমিক বয়সে তরুণ, অনেকেই অবিবাহিত। তাদের চাকরি নিয়ে তেমন কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তারা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের অনেকেই আন্দোলনে জড়িত না থেকেও গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন।
কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, আমবাগ ও জরুন এলাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ ও জব্বার মিয়াসহ অনেকে বলেন, ‘শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের জীবনেও। আমরা কখনও ফুটপাতে, কখনও ভ্যানে করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সিজনালি ব্যবসা করি। গন্ডগোলের আভাস পেলেই আতঙ্কে দৌড়ে পালাতে হয়। কারখানা ঠিকমতো না চললে আমাদের ব্যবসারও ক্ষতি হয়।’
বৃহস্পতিবার বিকালে চলমান শ্রমিক আন্দোলনের পর পোশাক কারখানায় নতুন নিয়োগ বন্ধসহ চার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। বিজিএমইএ’র মহাসচিব ফয়জুর রহমান স্বাক্ষরিত নির্দেশনার অনুলিপি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে সব পোশাকশিল্প কারখানায় সব ধরনের নতুন নিয়োগ বন্ধ থাকবে। প্রতিটি কারখানার গেটে নিয়োগ বন্ধ কথাটি লিখে ব্যানার টাঙিয়ে দিতে হবে। যেসব কারখানায় অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর বা মারামারির ঘটনা ঘটেছে সেসব কারখানা কর্তৃপক্ষকে নিকটস্থ থানায় প্রমাণস্বরূপ ছবি ও ভিডিও ফুটেজসহ মামলা করতে হবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম জানা না থাকলে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে মামলা করা যাবে। পাশাপাশি যেসব কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে কাজ করা থেকে বিরত থাকবে বা কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে সেসব কারখানার মালিককে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা ১৩ (১) বিধান মোতাবেক কারখানা বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে।
সর্বশেষ নির্দেশনায় যেসব কারখানায় ভাঙচুর- অগ্নিসংযোগ বা মারামারির ঘটনা ঘটেছে সেসব ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ (যদি থাকে) বিজিএমইএ’র কাছে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।