তৈরি পোশাক পল্লী হিসেবে খ্যাত মুন্সীগঞ্জে পঞ্চসার, রামপাল ও মিরকাদিম এলাকা। উন্নতমানের কাপড় দিয়ে নানা রঙ ও ডিজাইনের পোশাক তৈরি হচ্ছে এখানে। যেখানে রয়েছে প্রায় সহস্রাধিক পোশাক তৈরির ক্ষুদ্র কারখানা। এ বছর ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ৩০০ কোটি টাকার পোশাক বিক্রির টার্গেট এই পল্লীর কারখানা মালিকদের। পোশাক তৈরিতে এখন দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার পোশাক পল্লীর কারিগররা। এ বছর ভারতীয় পোশাক না আসায় পোশাকের চাহিদাও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন পোশাক পল্লীর মালিক ও কারিগররা।
রাজধানী থেকে ৩০ কিলোমিটার অদূরে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুন্নী, দর্গা বাড়ি, কাঁঠালতলা, রামপাল ইউনিয়নের সিপাহিপাড়া, সুখবাসপুর রামশিং ও পঞ্চসার ইউনিয়নের শাঁখারীবাজার, তেলেরবিলের ভট্টাচার্যের বাঁক গ্রাম। এসব গ্রামের প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি ক্ষুদ্র পোশাক কারখানা। ঈদকে সামনে রেখে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন বাহারি রঙের পোশাক তৈরি হচ্ছে। এখানকার তৈরি পোশাক ঢাকার সদরঘাট, কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বড় বড় পাইকারি মার্কেট হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপনিবিতানগুলোতে।
এই পোশাক পল্লীতে আধুনিক প্রযুক্তির কম্পিউটারাইজড অ্যামব্রয়ডারি মেশিনে করা হচ্ছে নানা রকম নান্দনিক কারুকাজ। পোশাককে বর্ণিল করতে কারিগররা নিপুণ হাতে যুক্ত করছেন রঙ-বেরঙের লেইস ও পুঁতি। কাপড় কাটা, সেলাই, ডিজাইনে বুঁদ হয়ে আছেন কারিগররা।
ভট্টাচার্যের বাঁক এলাকার জাহিদ মিনি গার্মেন্টসের কারিগর মো. ইয়াসিন ঢালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার আমাদের কাজের চাপ অনেক অনেক বেশি। রোজার ঈদের চার মাস আগ থেকে ২৬-২৭ রোজা পর্যন্ত চলবে ব্যস্ততা। আমরা এখন দৈনিক ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করছি, তাও কাজ শেষ করতে পারছি না। কারণ এ বছর আমাদের পোশাকের অনেক চাহিদা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি এবার আমরা কাজ করে কয়টা টাকার মুখ দেখবো। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে পাচ্ছি। কয়েক বছর আগে তো মন্দা অবস্থা ছিল। এবার একদিকে আমরা পোশাক তৈরি করছি, অন্যদিকে মালিক বিক্রি করছে। তাও কুলাতে পারছে না। মালের এত চাহিদা।’
একই এলাকার হাসনা মিনি গার্মেন্টসে কাজ করা রিপন মল্লিক বলেন, ‘আমাদের মালের (পোশাক) কোয়ালিটি অনেক ভালো। এবার অনেক নতুন ডিজাইনের মাল তৈরি করছি। এবার চাহিদা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ ভারত থেকে মাল আমদানি বন্ধ। ভারতের মাল যেহেতু বন্ধ সে কারণে কারিগর-মালিক সবাই মোটামুটি স্বস্তিতে আছে। এখানকার পোশাকের চাহিদা দেশের বড় বড় মার্কেটগুলোতেও অনেক বেড়েছে।’
রামপাল ইউনিয়নের সুখবাসপুর এলাকার মীম মিনি গার্মেন্টসের মালিক মো. রাসেল শেখ বলেন, ‘আগামীতে আরও ভালো ব্যবসা হবে বলে প্রত্যাশা করছি। কারণ ভারত থেকে আমদানি বন্ধ। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যগুলো অনেক কম চলেছে। এখন আমাদের কাজের চাহিদা অনেক বেড়েছে। কাজ করেও শেষ করতে পারছি না, সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৩টা-৪টা পর্যন্ত কাজ করেও সময় মতো ডেলিভারি দিতে পারছি না। সামনেও যদি ভারতীয় পোশাক আমদানি বন্ধ থাকে তাহলে দেশে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে এবং বাংলাদেশ শিল্পের দিক দিয়ে আরও এগিয়ে যাবে।’
ভট্টাচার্যের বাঁক এলাকার দেওয়ান মিনি গার্মেন্টসের মালিক মো. শামীম দেওয়ান বলেন, ‘আমরা পোশাক তৈরির কাঁচামাল ঢাকার ইসলামপুর, সদরঘাট থেকে কিনে আনি। এ বছর পোশাক তৈরির কাপড়, লেইস, লেজার, সুতা, বোতাম, চেইনের দাম অনেক বেশি। পোশাক তৈরি করে সেগুলো আবার ঢাকার সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটে বিক্রি করি। সেখান থেকে পাইকাররা নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। আমাদের এখানে পঞ্চসার ইউনিয়নের ভট্টাচার্যের বাঁক এলাকায় প্রায় ১৫টি মিনি গার্মেন্টস রয়েছে। প্রত্যেকটি গার্মেন্টসে ১২ থেকে ১৫ জন কারিগর আছে। তারা প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করছেন।’
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ বিসিক কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছর রমজানের ঈদ ঘিরে এখানকার ক্ষুদ্র কারখানাগুলোতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পোশাক বিক্রির টার্গেট রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এখানে পারিবারিক ঐতিহ্য ধারণ করে অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। কিছু কিছু এলাকা এমন রয়েছে যে প্রতিটা ঘরই একেকটি ক্ষুদ্র গার্মেন্টস। সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুন্নী, দর্গা বাড়ি, কাঁঠালতলা, রামপাল ইউনিয়নের সিপাহিপাড়া, সুখবাসপুর রামশিং ও পঞ্চসার ইউনিয়নের শাঁখারীবাজার, তেলেরবিল, ভট্টাচার্যের বাঁক এলাকায় প্রায় সহস্রাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব মিনি গার্মেন্টসে সারা দেশ থেকে কর্মচারীরা এসে কাজ করে। এই পোশাকপল্লীতে অন্তত ৩০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ধারাটি অব্যাহত থাকলে এক সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই মিনি গার্মেন্টস পল্লীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য উন্নত ডিজাইন সরবরাহ, প্রশিক্ষণ প্রদান, মার্কেটিংসহ যেকোনও ধরনের সুবিধা দিতে বিসিক তাদের সঙ্গে আছে।’