প্রতিদিন লোকসান গুনছে বঙ্গবন্ধু টানেল
বাংলাদেশ

প্রতিদিন লোকসান গুনছে বঙ্গবন্ধু টানেল

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু দিয়ে যানবাহন পার হতে টোল প্লাজার সামনে প্রতিদিন দীর্ঘ জট সৃষ্টি হচ্ছে। এ সেতু দিয়ে দৈনিক ২৮ থেকে ৩০ হাজার যানবাহন পার হচ্ছে। এতে দৈনিক টোল বাবদ আদায় হচ্ছে ২৩ লাখ টাকার বেশি। অপরদিকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দিয়ে দৈনিক পার হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার গাড়ি। এতে টোল বাবদ আদায় হচ্ছে ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। অথচ টানেল প্রকল্পে দৈনিক খরচ ৩৭ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক সমীক্ষা ছাড়াই টানেল প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে আদৌ টানেলের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পের প্রয়োজন ছিল কিনা তা বিবেচনা করে দেখা হয়নি। যে কারণে টানেল দিয়ে পর্যাপ্ত গাড়ি চলছে না। শাহ আমানত সেতু দিয়ে চলাচলকারী গাড়ি থেকে যে পরিমাণ টোল নেওয়া হয়, টানেলে টোলের হার তার তিন গুণ বেশি। এ কারণেও টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে না। টানেলে দৈনিক যে খরচ তার অর্ধেকও টোল বাবদ ওঠে আসছে না। দেশবাসীর ওপর পড়েছে টানেল নামের বিলাসী এ প্রকল্পের খড়গ।

চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত সেতু দিয়ে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে ৭৪ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৩টি যানবাহন চলাচল করেছে। এতে টোল বাবদ আয় হয়েছে ৬৪ কোটি ৪৯ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৪ টাকা। গত বছর এ সেতু দিয়ে পার হয়েছে ৯১ লাখ ২ হাজার ৪২৫টি গাড়ি। এতে টোল বাবদ আদায় হয়েছে ৭৯ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার ৩৮৭ টাকা। চলতি বছরের মধ্যে গত অক্টোবর মাসে পার হয়েছে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৬৩৮টি গাড়ি। এতে আয় হয়েছে ৭ কোটি ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৭ টাকা। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ৭ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৬টি গাড়ি পার হয়েছিল। এতে টোল বাবদ আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৭১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

টানেল সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৯ অক্টোবর উদ্বোধনের পর যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করা হয় টানেল। এক বছরে টানেল দিয়ে টোল আদায় হয় ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রথম বছর যেখানে টানেল দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে ১৮ হাজার গাড়ি চলাচল করার কথা ছিল, সেখানে চলছে চার হাজারেরও কম। টোল থেকে প্রতিদিন ১১ লাখ টাকা আয় হলেও ব্যয় ৩৭ লাখ টাকা। এতে পরিচালন ব্যয়ের অর্ধেকও উঠে আসছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর চেয়ে টানেলে টোলের হার প্রায় তিন গুণ বেশি। এ কারণেও অনেক গাড়ি টানেলের পরিবর্তে শাহ আমানত সেতু ব্যবহার করছে।

শাহ আমানত সেতুতে টোলের হার

ট্রেলার ১০ চাকার ৭৫০ টাকা, বড় ট্রাক ৩০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ২০০ টাকা, মিনি ট্রাক ১৩০ টাকা, বড় বাস ১৫৫ টাকা, মিনি বাস ৫০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত যান ১৩৫ টাকা, মাইক্রোবাস/জিপ ১০০ টাকা, প্রাইভেটকার ৭৫ টাকা, সিএনজি/টেম্পু (তিন চাকার মোটরযান) ৩০ টাকা। মোটরসাইকেল থেকে টোল নেওয়া হয় না।

 বঙ্গবন্ধু টানেলে টোলের হার

কার/জিপ ২০০ টাকা, পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ আসন বা এর কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ আসন বা এর বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩ এক্সেল) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ৪০০ টাকা, ট্রাক ৮.০১ টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ৬০০ টাকা, ট্রাক/টেইলার (৩ এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রাক/ট্রেইলার (৪ এক্সেল) ১০০০ টাকা এবং ট্রাক/ট্রেইলার (৪ এক্সেলের অধিক) ১০০০ টাকা।

টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। তখন ২০১৭ সালকে টানেল চালুর বছর ধরে এ সমীক্ষা করা হয়েছিল। যদিও টানেল চালু হয় ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর। ওই সমীক্ষায় বলা হয়, টানেল চালুর বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি গাড়ি চলতে পারে। ২০২০ সালে তা প্রায় ২১ হাজার ও ২০২৫ সালের দিকে প্রতিদিন প্রায় ২৮ হাজারের মতো যান চলাচল করার কথা বলা হয়। অথচ বর্তমানে টানেল দিয়ে গাড়ি পার হচ্ছে দৈনিক সাড়ে ৪ হাজারের মতো। অর্থাৎ বর্তমানে যে পরিমাণ গাড়ি পার হচ্ছে তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩০ শতাংশ। যে কারণে টোল আদায়ও হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০ শতাংশ কম।

শাহ আমানত সেতু

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের প্রয়োজন আছে কিনা, এখানে টানেল নাকি সেতুর প্রয়োজন ছিল, এটা নিয়ে সমীক্ষা হয়নি। সমীক্ষা হয়েছিল এখানে টানেলই করতে হবে। এ জন্য ভুল তথ্য দিয়ে টানেল যাতে হয়, সেটাই করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে টানেল পার হয়ে আমরা আনোয়ারা প্রান্তে কেন যাবো, আবার কেনইবা পতেঙ্গায় আসবো। সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ সাগর উপকূলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটি কত বছরের মধ্যে তার কোনও টাইমলাইন নেই। এই প্রকল্প নির্মাণের আগে বিশেষজ্ঞ টিমকে একাধিকবার বলেছি, দক্ষিণ প্রান্তে কারখানা গড়ে উঠবে, তার ওপর অনুমান করে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণ করে ফেলা হবে। এর কোনও যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। টানেল প্রকল্পের নামে অর্থের লুটপাট হয়েছে।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ না করে টানেল নামের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের আদৌ প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা, দেশের অনেক স্থপতি উচ্চাভিলাষী এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে সে সময় না করার ওপর যুক্তি তুলে ধরেছিল। কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে মেগা প্রকল্প মানেই ছিল মেগা দুর্নীতি, অর্থের হরিলুট। এ কারণে টানেলের মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করেছিল। টানেলে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে ১০টি ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। যারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে  তারা সরকারের শেখানো তথ্য পরিবেশন করেছে, ভুল তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে।’

টানেল নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার।

Source link

Related posts

নারায়ণগঞ্জে পত্রিকা অফিসে হামলা, আরও ৩ আসামি রিমান্ডে

News Desk

লুট হওয়া ১১ অস্ত্র মিয়ানমার থেকে ফেরত পাওয়ার আশা বিজিবির

News Desk

৩৩ মাস পর নিজ এলাকায় যাচ্ছেন ওবায়দুল কাদের

News Desk

Leave a Comment