বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে অনেক “প্রথম” রয়েছে, যা আমাদের গর্বিত করে। এসব প্রথম অর্জনগুলো দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং জাতির জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই আর্টিকেলে আমরা এমন কিছু উল্লেখযোগ্য “প্রথম” নিয়ে আলোচনা করব যা বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
১. বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ হিসেবে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছিল। যদিও এটি তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার ভেঙে দেয়, পরে ১৯৬৩ সালে বর্তমান শহীদ মিনারটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। এটি পৃথিবীর একমাত্র স্মৃতিসৌধ যেখানে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের স্মৃতি চির অম্লান।
২. বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে। পতাকার ডিজাইনে সবুজ রঙের পটভূমিতে লাল বৃত্ত এবং সোনালী রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনাকালে জনগণের আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
৩. বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই দুই মহান নেতা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নবনির্মাণ এবং অগ্রগতির মূল কারিগর হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।
৪. বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী
বাংলাদেশের প্রথম নভোচারী হলেন ড. মাইকেল এস মুশাররফ। তিনি নাসার পক্ষ থেকে নভোচারী নির্বাচিত হন এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এছাড়াও, মাহমুদ সাদেক মেহেদী ছিলেন একজন কৃতিত্বপূর্ণ নভোচারী, যিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ভ্রমণের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
৫. বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার
১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রতিষ্ঠা হয়, যা দেশের প্রথম এবং প্রাচীনতম টেলিভিশন চ্যানেল। ঢাকা শহরের ডিআইটি ভবনে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল এবং সেই সময় থেকে বিটিভি দেশের জনসাধারণের বিনোদন, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি প্রচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
৬. বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট
২০১৮ সালের ১২ মে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের স্যাটেলাইটধারী দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট দেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখছে।
৭. প্রথম নারী পাইলট
ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রোকসানা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক বিমান পাইলট, যিনি ১৯৭৭ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে যোগদান করেন। বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতিতে তার অবদান ছিল অসামান্য এবং তিনি ভবিষ্যতের নারী পাইলটদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।
৮. প্রথম ডাকটিকেট
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই। এই ডাকটিকেটগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীকসমূহ চিত্রিত করা হয়েছিল, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্মারক ছিল এবং বিশ্বব্যাপী দেশের পরিচিতি প্রকাশ করেছিল।
৯. প্রথম নারী বিচারপতি
জাস্টিস নাজমুন আরা সুলতানা ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তার এ অর্জন নারীর ক্ষমতায়ন এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক।
১০. বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) যা ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের চিকিৎসা গবেষণায় এক বিশাল পদক্ষেপ এনে দিয়েছে।
১১. বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় নির্মাণাধীন। এটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
১২. বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল
বাংলাদেশে প্রথম সিনেমা হল ছিল ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে তৈরি করা একটি স্থায়ী হল, যার নাম ছিল “দ্য ক্রাউন থিয়েটার”। পরে এটি মুকুল সিনেমা হল নামে পরিচিতি পায়। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা ছিল “মুখ ও মুখোশ” (১৯৫৬), যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রথমের ঘটনা ও অর্জন শুধুমাত্র দেশের জন্য গর্বের বিষয় নয়, বরং এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ, যা আমাদেরকে একটি পরিচয় দেয়। এসব অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং বৈচিত্র্যের ধারাবাহিকতার একটি অংশ, যা আমরা বুকে ধারণ করি। এসব “প্রথম” ঘটনাগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে এবং জাতির গৌরবময় ইতিহাসের একটি অংশ হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।